ঢাকা ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/১৯৯)

রুহের জ্বলনে সার্থক হবে জীবন

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
রুহের জ্বলনে সার্থক হবে জীবন

একবার এক বেদুইন কাফেলা মদীনায় এলো। তারা ছিল কাফের। সন্ধ্যা নাগাদ তারা মসজিদে নববীতে অব স্থান নিল। রাত হলে নবীজি মেহমানদের ভাগ করে দিলেন সাহাবীদের মাঝে। কারণ, তারাও নবীজির সাহচর্যের প্রভাবে অতিথিপরায়ণ। দেহের উপর প্রাণের প্রভাব যেমন সাহাবায়ে কেরামের মাঝে নবীজিরও ছিল প্রাণের মতো। তার স্বভাব-আচার তাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল সবদিকে। ইশার নামাজের পর সাহাবীরা প্রত্যেকে একেকজন মেহমান নিয়ে গেলেন বাড়িতে। রয়ে গেল সুঠামদেহী কদাকার এক বেদুইন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বন্য গড়নের লোকটি পেটুক হবে। অবশেষে নবীজি নিয়ে গেলেন বিশাল বপু কদাকার লোকটি। সে রাতে নবীজির ঘরে খাবারের আয়োজন ছিল সাতটি দুধেল ছাগলের দুধ, সেই পরিমাণ রুটি, তরকারি। মেহমানের সামনে খাবার পরিবেশিত হলো। পেটুক গোগ্রাসে গিলতে লাগল একটানা। দেখতে না দেখতে, বাড়ির সবার জন্য তৈরি রাতের খাবার একাই সাবাড় করল। ভেতরে ভেতরে অনেকের মনে ক্ষোভ। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। থাকার ব্যবস্থা করা হল একটি কামরায়।

শুরু হলো বেদুইনের নাক ডাকা। শেষ রাতে কাফেরটির পেটে মোচড় দিল। মনে মনে বলল, ভোর হোক, তারপর। আনমনা হলে আবারো চোখে ঘুম নেমে এল। স্বপ্ন দেখে, এক বিজন বিরান ভূমিতে পাঁয়চারী করছে। আশপাশে লোকজন নেই। ভালো একটা জায়গা পেয়ে গেল বাথরুম সারার। আরামচে নিজেকে ভারমুক্ত করল।

গশত বীদার ও বেদীদ আ’ন জা’মে খা’ব

পুর হাদাস দীওয়ানে শুদ আয এযতেরা’ব

ঘুম ভেঙে দেখে, বিছানাপত্র অপবিত্র একাকার

মলমূত্রে, লজ্জায় পাগল হয়ে পথ খুঁজে পালাবার।

বাইরে উঁকিঝুঁকি দিল। এখনো কেউ জাগেনি। সুযোগ বুঝে চম্পট দিল ঝড়ের বেগে। রাত থেকে মেহমানের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন নবীজি। এক খাদেম এসে জানাল, হযরত! আপনার মেহমান লাপাত্তা। বিছানাপত্র মলমূত্রে একাকার, দেখুন কি অব স্থা। একটি কাপড় দেখিয়ে বলল,

কে চুনীন কর্দআস্ত মেহমা’নাত বেবীন

খান্দেয়ী যদ রাহমাতুল লিল আলামীন

দেখুন আপনার মেহমানের কাণ্ড কত হীন

দেখে মৃদু হাসলেন রাহমাতুল লিল আলামীন।

নবীজি বললেন, হায়! কত কষ্ট হল মেহমানের। বললেন, তোমরা পানির বালতি নিয়ে এসো। আমি নিজেই পরিষ্কার করব, আমার মেহমানের বিছানাপত্র। কারো সাহস হলো না, পরিচ্ছন্নতার কাজটি নিজে করবে। কারণ, নবীজি বলেছেন, আমার উপর নির্দেশ আছে এই কাজের।

কতদূর গিয়ে বেদুইন দেখে তার পূজনীয় মূর্তিটি নেই। যে মূর্তি সে তাবিজের মতো সঙ্গে সঙ্গে রাখে। মূর্তি কি না বিপদাপদে তার সহায়, রক্ষাকবচ। রাতের বিছানায় এক পাশে ঝুলিয়ে রেখেছিল সখের মূর্তি। এখন ভাবে, কীভাবে ফিরে যাব, লজ্জায় কীভাবে মুখ দেখাব ওদের। তবুও মূর্তির লোভ তাকে কাবু করল। হ্যাঁ! লোভ বড় আজদাহা। একে যদি তুচ্ছ ভাব, ভুল হবে তা। বেদুইনের লজ্জা পরাস্ত হলো লোভের কাছে। লজ্জা শরম একপাশে রেখে ফিরে চলল মদীনায়। যেভাবেই হোক, আমার মূর্তি ফিরে পাওয়া চাই। কাছে গিয়ে সন্তর্পণে পা রাখে, উঁকি দেয়, কেউ যেন না দেখে।

কিন্তু অবাক এক দৃশ্য দেখে তার হুঁশজ্ঞান রহিত। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তার মলমূত্রে নোংরা কাপড়-চোপড় ধুয়ে সাফ করছেন। আরো বলছেন, হায় রাতে মেহমানের কত না কষ্ট হলো। এই দৃশ্য দেখে বেদুইন আত্মহারা। দুই হাত মাথায় মেরে চিৎকার দেয়, এই যে! মদীনার বাদশাহ নিজে, আল্লাহর নবী হয়ে আমার এমন হীন কর্মটি পরিষ্কার করছেন। তার হৈচৈ শুনে লোকেরা জড়ো হলো। সে মাটিতে সেজদায় লুটে শুধুই বলছে, আমি লজ্জিত, অপদার্থ। আপনি কি না আল্লাহর ভয়ে এমন কাজ করেন। অথচ সেই আল্লাহকে ভুলে আমি দিকহারা। আল্লাহর নবীকে কষ্ট দিয়ে আখেরাতে আমার কি উপায় হবে?

তার কান্না হৈচৈ চিৎকার অনুতাপ দেখে নবীজি সদয় হলেন। পাশে ডেকে সান্ত¡না দিলেন। খুলে দিলেন তার হৃদয়ের চোখ।

তা নগিরয়াদ ইন কেই খান্দাদ চামান

তা নগিরয়াদ তিফল কাই জূশাদ লাবান

যতক্ষণ না কাঁদবে আকাশ হাসবে কি ফুলের কানন

শিশু যতক্ষণ না কাঁদবে, স্তনে কি হবে দুধের স্ফুরন?

তুমি জান না যে, ধাত্রীদের ধাত্রী যিনি, তিনি বান্দার ক্রন্দন ছাড়া তার মুফত দুধ খুবই কম দেন। তিনিই বলেছেন,

গোফত ফালইয়াবকু কাসিরান গূশ দা’র

তা বেরীযদ শীরে ফযলে কির্দেগার

বলেন, তারা কাঁদুক বেশি বেশি, শুনো মনের কানে

আল্লাহর দয়ার দুধের নহর তাদের জন্য যাহাতে নামে।

মেঘের কান্না আর সূর্যের উত্তাপ। এ দুটিই হচ্ছে বিশ্বব্যবস্থার নিয়মক। তুমিও এই দুইয়ের আশ্রয় নাও। চোখের অশ্রু আর হৃদয়ের উত্তাপ হোক তোমার সম্বল। চিন্তা করো, সূর্যের দহন জ্বলন যদি না হত, মেঘমালার অশ্রুর বরিষণ যদি না হত, তাহলে কি ঋতুচক্রের আবর্তন হত? তখন তো সৃষ্টিকূলের জীবনপ্রবাহ থেমে যেত। তুমিও-

আফতা’বে আকল রা’ দর সূয দা’র

চশম রা’ চোন আবর আশক আফরোয দা’র

জ্ঞানবুদ্ধির সূর্যকে রাখ আলোকময় উষ্ণতর

চোখকে রাখ অশ্রু বর্ষণরত মেঘমালার মতো।

শিশুদের মতো তোমার চাই ক্রন্দসী দুই চোখ। রুটি কম খাও, কম কর উদরের সেবা। কারণ, তা লুটে নেবে তোমার মান-সম্মান সবটা। হযরত আলী (রা) বলেছেন, ‘সেই লোকের প্রতি দয়াশীল হও, যার একমাত্র সম্বল আল্লাহর প্রতি আশা আর যার হাতিয়ার কান্না’। দেহ যদি রাতদিন পানাহারে ভর্তি হয়ে থাকে, তাহলে তোমার রূহের অব স্থা হবে শীতের প্রকোপে জ্বরাগ্রস্ত গাছের মতো পত্র পল্লবহীন। কাজেই যত শিগগির সম্ভব, দেহকে দুর্বল করে রূহকে প্রবল কর। দেহের কাছ থেকে ধার নাও, তা কর্জ দাও আল্লাহকে। যেমনটি বলা আছে সূরা হাদীদে (আয়াত, ১১ ও ১৮)। তবেই তিনি তোমার অন্তরের জমিনে বসন্তের বাগান ফলাবেন। তোমার দেহ যদি মলমূত্র থেকে খালি রাখ, আল্লাহ তোমার অন্তরে মিশক আম্বর ও মণি-রত্ন ভরে দেবেন। তোমার অস্তিত্বকে যদি যৌনতার অবৈধ কামনা থেকে মুক্ত রাখতে পার, উর্ধ্বলোকের আধ্যাত্মিক জ্ঞানে আল্লাহ তোমাকে সমৃদ্ধ করবেন। দেহের নাপাকি সাফ করলেই সত্যিকার পবিত্রতায় উদ্ভাসিত করবেন তোমার মন ও চরিত্র।

শয়তান তোমাকে ভয় দেখায়, সুযোগ হাতছাড়া করো না, পস্তাতে হবে পরে। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা, নগদ যা পাও হাত পেতে নাও। তোমার দেহ তোমার বাহন। বাহন দুর্বল হলে চলবে কি করে, এ জাতীয় আরো অনেক যুক্তি খাড়া করে বলবে, তোমার অভ্যাস বদলাতে যাবে না, লোকেরা কী বলবে? শয়তান এ জাতীয় নানা মন্ত্র পাঠ করে মনের কাছে। সহিস যেমন ঘোড়ার মুখে লাগাম পরায় তারপর যেদিকে ইচ্ছা নিয়ে যায়, শয়তানও তোমার বিবেকের মুখে লাগাম পরিয়ে টেনে নেয় সন্দেহ-সংশয়ের টানা পড়েনে। তখন তুমি হয়ে যাও দুদিল বান্দা। জীবনের উন্নতির জন্য কোনটা করবে, কোনটা ছাড়বে, তা নিয়ে পড়ে যাও দোটানায়। খবরদার-

আন বকুন কে হাস্ত মুখতা’রে নবী

আন মকুন কে কর্দ মজনুন ও সবী

কাজ করো আমার প্রিয় নবীর পছন্দ যেমন

করো না কোনো কাজ শিশু ও উম্মাদের মতো।

মওলানা রুমি আরো বলেন, জান্নাতের উপর আচ্ছাদন আছে। সেই আচ্ছাদন সরালেই তুমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। সেই আচ্ছাদন হলো কষ্ট আর কষ্ট। দেখ না, কৃষকের কষ্টকর পরিশ্রমের পরই খেতখামার ফলে ফুলে হেসে উঠে। এই সাধনায় সর্বাব স্থায় সতর্ক থাকতে হবে শয়তান সম্পর্কে। তুমি যত বড় জ্ঞানী হও, বুযর্গ হও নফসের সহায়তায় শয়তান তোমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। এর থেকে বাঁচার জন্য তোমার আকল বুদ্ধিকে আরেকজন আকলমন্দ বন্ধুর সঙ্গে যুক্ত কর। কোরআনেই তো বলা আছে, পরস্পর পরামর্শ করে চলো। (সূরা শুরা : আয়তাংশ-৩৮)। বেদুইনের হাহুতাশের অন্ত ছিল না। নবীজি তাকে অভয় দিলেন, তোমার কান্না বিফলে যায়নি। এদিকে এসো। এতকাল বেঘোর নিদ্রায় ছিলে, এবার জীবন জাগার চেতনায় জেগে উঠ। নবীজির দয়া দেখে বেদুইনের কান্না থেমে গেল। বলল, হে মহানুভব! আমাকে কলেমা দিন। আমি সাক্ষ্য দিতে চাই, আল্লাহ ও তার রাসূল সত্য। এই ঈমান তো সেই স্বীকারোক্তির বাস্তব সাক্ষ্যদান ও পরীক্ষা, যা সৃষ্টির আদিতে নেয়া হয়েছিল। মৌখিক সেই সাক্ষ্যের প্রমাণ দিতে হয় আমাদের নামাজ ও রোজায়।

ইন নামাজ ও রোযা ও হজ্জ ও জেহাদ

হাম গওয়াহী দাদন আস্ত আয এতেকাদ

এই যে আমাদের নামাজ রোজা, হজ ও জিহাদ

এ তো সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করা আমাদের বিশ্বাস।

বেদুইন চাইল ঈমানের সম্পদ নিয়ে বিদায় নেবে। নবীজি বললেন, তোমাকে আজ এখানে থাকতে হবে। দিন শেষে রাত এলো। যথারীতি খাবার পরিবেশিত হল। কিন্তু অল্প খেয়েই বেদুইন হাত গুটিয়ে নিল। বলল, আর খেতে পারি না। লোকেরা জানতে চাইল রহস্য। নবীজি বললেন, কাফের আহার করে সাত আঁত ভরে আর মুসলমান খায় এক আঁতে’। মওলানা রুমি বলেন, ঈমানের হাকিকত যখন হৃদয়ে উদিত হয়, মন থেকে লোভ মোহের আবর্র্জনা জ্বালিয়ে দেয়। যদি কেউ মুসলমান হয়েও লোভের ডোবায় হাবুডুবু খায়, বুঝতে হবে ঈমানের হাকিকতের নাগাল সে পায়নি।

আমরা তার (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত, ৬৪-২০০)

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত