ঢাকা ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কবর আখের ঠিকানা

শরিফ আহমাদ
কবর আখের ঠিকানা

প্রত্যেকটি মুসলমান বিশ্বাস করেন কবর হবে তার শেষ ঠিকানা। সাড়ে তিন হাত মাটির বাড়ি আসল গন্তব্য। দুদিন আগে পরে সবাইকে নির্ধারিত ওই ঠিকানায় যেতে হবে। কার কখন ডাক আসে বলা যায় না। তাই সর্বদা ওখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হয়। বারাআ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা একটি জানাজায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে শরিক ছিলাম। তিনি একটি কবরের পাশে বসলেন, পরে কাঁদতে শুরু করলেন। এমন কি তার চোখের পানিতে মাটি ভিজে গেল। অতঃপর তিনি বললেন, হে আমার প্রিয় ভাইয়েরা, (তোমাদের অবস্থা) এর মতই হবে। সুতরাং তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো। (ইবনে মাজা : ৪১৯৫) এখানে কবর সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো।

কবর খননের নিয়মকানুন : প্রত্যেকটি কবর মাইয়েতের সমপরিমাণ লম্বা হবে। যতটুকু লম্বা তার অর্ধেক পরিমাণ চওড়া হবে এবং দেহের লম্বা অনুপাতে গভীর হওয়া উত্তম। কবর খননের সুন্নাত তরিকা দুটি। এক. লাহাদ বা বুগলি। এই কবরের বৈশিষ্ট্য প্রথমে একটি গর্ত খনন করা। অতঃপর এ গর্তের তলা থেকে কিবলার দিকে আরেকটি গর্ত খনন করে সে গর্তে লাশ রেখে দেওয়া। দুই. সিন্দুক বা শাক্ক। এই কবরের বৈশিষ্ট্য প্রথমে একটি গর্ত খনন করা। অতঃপর কবরের মধ্যভাগে আরেকটি গর্ত খনন করে সে গর্তে লাশ রেখে দেওয়া। উভয় প্রকারের কবরের লাশ রাখার জন্য খনন করা গর্তটির তলা কিবলার দিকে এমনভাবে কাত করে খনন করতে হয় যে, লাশ রাখলেই ডান কাত হয়ে যায় এবং সিনা কিবলামুখী হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালার ইশারায় রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বুগলি কবর দেওয়া হয়েছিল। আনাস (রা.) রাসুল (সা.) মৃত্যুবরণ করার পর তিনি বললেন, এক ব্যক্তি বুগলি কবর খনন করতো আর অপর ব্যক্তি সিন্দুক কবর খনন করত। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা আমাদের প্রভুর কাছে কল্যাণ কামনা করি এবং উভয়ের কাছে লোক প্রেরণ করি। দু'জনের মধ্যে যিনি আগে আসেন কবর খননের বিষয়টি আমরা তার দায়িত্বে ছেড়ে দিবো। অতঃপর দু’জনের কাছে লোক পাঠালেন এবং যিনি বুগলি কবর খনন করেন তিনি আগে এলেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য বুগলি কবর খনন করলেন। (মুসনাদে আহমাদ : ১২৪১৫)।

যেভাবে দাফন করা হয় : কবরে মাইয়েতকে রাখার জন্য কতজন ব্যক্তি নামবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। বরং প্রয়োজন অনুসারে নামাই উত্তম। কবরে লাশ রাখার সময় পশ্চিম দিক থেকে নামাতে হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারিম (সা.) রাতে একটি কবরের কাছে গেলেন। (রাতের আঁধার থাকার কারণে) তার জন্য বাতি জ্বালানো হলো। তিনি কিবলার দিক থেকে লাশ গ্রহণ করলেন এবং মৃত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন। তুমি আল্লাহর ভয়ে অনেক বেশি ক্রন্দন করতে এবং কোরআনে কারিম অনেক বেশি তিলাওয়াত করতে। রাসুল (সা.) তার জানাযায় চার তাকবির বললেন। (তিরমিজি : ১০৫৭)। কবরে মাটি দেওয়ার সময় এই দোয়া পাঠ করতে হয়। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসুল (সা.)-এর মেয়ে উম্মে কুলসুম (রা.) কে কবরে রাখা হয়, তখন রাসুল (সা.) পড়েন, মিনহা খালাকনাকুম ওয়াফিহা নুয়ীদুকুম ওয়ামিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা। (মুসনাদে আহমাদ : ২২১৮৭, মুস্তাদরাকে হাকেম : ৩৪৩৩)।

দাফনের পর করণীয় কাজ : মাইয়েতকে দাফন পরবর্তী সব কাজ সমাপ্ত হলে প্রশ্ন করার জন্য কবরে মুনকার নাকির নামে দুজন ফেরেশতা আসেন। মৃত ব্যক্তি যেন ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে তাদের প্রশ্নোত্তর দিতে পারে এজন্য দোয়া করতে হয়। উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) যখন কোন মৃত ব্যক্তির দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেন, তখন তিনি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করো এবং সে যেন সুদৃঢ় থাকতে পারে তার জন্য দোয়া কর। কেন না, এখনই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (আবু দাউদ : ৩২০৭)। দাফনের পর খুব তাড়াহুড়ো নয়, একটু সময় দিয়ে দোয়া করা উচিত। আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি মুমূর্ষু অস্থায় খুব কাঁদলেন...। এরপর তিনি (সন্তানদের) বললেন, তোমরা যখন আমাকে দাফন করবে, তখন আমার উপর ধীরে ধীরে মাটি দিবে। এরপর আমার কবরের পাশে ততক্ষণ অবস্থান করবে, যতক্ষণ একটি উট যবেহ করে গোস্ত বণ্টন করতে সময় লাগে। যাতে আমি তোমাদের কারণে স্বস্তি লাভ করতে পারি এবং আমার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতাগণের উত্তর সহজে দিতে পারি। ( মুসলিম : ৩৩৬)।

কবরের প্রশ্ন ও শাস্তির বর্ণনা : মাইয়েতকে কবরে মূলত চারটি প্রশ্ন করা হয়। রব, ধর্ম ও নবী সম্পর্কিত এই তিনটি প্রশ্নই হলো মূল। প্রশ্নের উত্তর অনুযায়ী কবর হয়তো জান্নাত অথবা জাহান্নামের গর্তে পরিণত হয়। আবু দাউদ এর ৪৬৭৮ নং হাদিসে দীর্ঘ বিবরণ পেশ করা হয়েছে। ?কবরের আজাব সম্পর্কে একটি বর্ণনা এমন- আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মৃত ব্যক্তিকে যখন কবরে রাখা হয়, তখন দুইজন কালোবর্ণের ও নীল চক্ষুবিশিষ্ট ফেরেশতা তার কাছে আসেন। একজনকে বলা হয় আল-মুনকার আর অপরজনকে বলা হয় আন-নাকীর। তারা বলেন, এই ব্যক্তি (নবী) সম্পর্কে তুমি কী বলতে? সে তখন (দুনিয়াতে) তাকে যা বলতো তাই বলবে যে, ইনি হলেন আল্লাহর বান্দা ও তার রাসুল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি কোনো ইলাহ নেই আল্লাহ ছাড়া, আর মুহাম্মাদ তার বান্দা ও তার রাসুল। তার পর তারা বলবেন আমরা জানতাম যে তুমি এই কথা বলবে। এরপর তার কবর সত্তর গজ প্রশস্ত করে দেওয়া হবে এবং তার জন্যে এটি আলোকিত করে দেওয়া হবে। এরপর তাকে বলা হবে তুমি ঘুমিয়ে পড়। ওই ব্যক্তি বলবে, আমি আমার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যেতে চাই, যাতে এই খবরটি তাদের দিতে পারি। তখন ফেরেশতা দুইজন বলবেন, নয়া দুলহার মতো তুমি ঘুমিয়ে থাক। যাকে তার পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া জাগায় না। অবশেষে আল্লাহতায়ালা তাকে তার এই শয্যা থেকে উত্থিত করবেন। আর মৃত ব্যক্তি যদি মুনাফিক হয়, তবে সে (ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তরে) বলবে, আমি তো জানি না, তবে লোকদের যা বলতে শুনেছি আমিও তাই বলেছি। ফেরেশতারা বলবে, আমরা জানতাম তুমি এই ধরনেরই কথা বলবে। এরপর জমিনকে বলা হবে একে চাপ দাও। তখন জমিন তাকে চাপ দিবে। ফলে তার পাঁজরের হাড়গুলো একটার ভেতর অন্যটা ঢুকে যাবে। এভাবে সে আজাব ভোগ করতে থাকবে, অবশেষে তাকে আল্লাহতায়ালা তার এ শয্যা থেকে উত্থিত করবেন। (তিরমিজি : ১০৭১)।

কবরের আজাব থেকে বাঁচা : কবরের ভয়াবহ আজাব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর বিধান এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা? জরুরি। অন্যথায় সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। উসমান (রা.)-এর আজাদকৃত গোলাম হানী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উসমান ইবন আফফান (রা.) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন, তখন তিনি এমন কাঁদতেন তার দাড়ি অশ্রুসিক্ত হয়ে যেতো। তখন তাকে বলা হলো, আপনি তো জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা করেন এবং আপনি রোদন করেন না। অথচ আপনি কবর দেখলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, এর কারণ কী? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় কবর আখেরাতের প্রথম মনজিল। কেউ যদি এ থেকে মুক্তি পায়, তাহলে এর পরে যা আছে, তা এর চেয়ে সহজ হবে। আর এখান থেকে সে যদি নাজাত না পায়, তাহলে এর পরে যা আছে, তা এর চেয়ে আরো কঠিন হবে। রাবি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কবরের চেয়ে ভয়াবহতম কোনো দৃশ্য কখনো দেখিনি। (ইবনে মাজাহ : ৪২৬৭)।

লেখক: কবি ও শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত