ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০৩)

ময়ূরের পেখম উপড়ানোর রহস্য

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ময়ূরের পেখম উপড়ানোর রহস্য

সমতলভূমিতে এক ময়ূর তার সুন্দর পেখমগুলো উপড়াচ্ছিল নিজের ঠোঁটে। এক পণ্ডিত লোক যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়ে। ময়ূরের সাথে তিনি কথা বললেন দর্শনের যুক্তি সাজিয়ে। ময়ূর! তুমি কি জান না তোমার পেখম পুচ্ছের কদর কত? নিজের পেখম নিজে ছিঁড়লে তুমি বিবসনা বিশ্রী হয়ে যাবে। পেখম তো তোমার গায়ের জামা, রূপের সাজ, গর্বের ধন। কাদায়, মাটিতে এভাবে ছুঁড়ে ফেলছ, তুমি কি আহম্মক? জান না, মকতবের শিশুরা তোমার পেখম দিয়ে কোরআন শরীফে নিশান বানায়? আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি কীভাবে অকৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছ? সুন্দর, হৃদয়কাড়া, দৃষ্টিনন্দন পালক, পেখম তোমায় আল্লাহই দিয়েছেন। তুমি এত অভিমান দেখাও কার সাথে? অত অমুখাপেক্ষী বেনেয়াজ মনে করো না নিজেকে।

আই বসা’ নাযা’ কে গর্দদ আ’ন গুনাহ

আফগনদ মর বন্দা রা’ আয চশমে শা’হ

অনেক অভিমানি, ঠমকে এমন গুনাহ করে

বান্দাকে ত্যাজ্য বানায় স্বয়ং বাদশাহর নজরে।

কোনো কোনো অভিমান, অমুখাপেক্ষী আচরণ, এমন গুনাহের কারণ হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত বান্দাকে মহান আল্লাহর দরবারে বঞ্চিত করতে পারে। কাজেই আল্লাহর সমীপে, এই জগতে কখনো নিজেকে বেনেয়াজ, অমুখাপেক্ষী ভাবতে নেই। কারণ, এমন মনোভাব তোমার মধ্যে অহংকার, অবাধ্যতা সৃষ্টি করবে। মওলানা আরো বলেন, অভিমান দেখানো মিষ্টান্ন খাওয়ার মতো বেশ মজা। কিন্তু মিষ্টান্ন তো তোমার শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ। অভিমান দেখাচ্ছ আর নিজেকে ভাবছ, বেশ ফুরফুরে? কিন্তু যার সাথে অভিমান তিনি যদি তোমার দিকে ফিরে না তাকান, মুখ ফিরিয়ে নেন, তোমার অবস্থা কী হবে? কাজেই আল্লাহর সাথে মান-অভিমান দেখাতে নেই। সবসময় নিজেকে আল্লাহর কাছে ছোট, মুখাপেক্ষী করে রাখাই নিরাপদ। যদি তার প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাক, মনে হবে তুমি দুর্বল, মাটির সাথে মিশে আছ; কিন্তু এই অনুভূতি তোমার বুকটা চাঁদের মতো আলোকিত করবে।

তুমি যদি শীতকাল হয়ে যাও, যদি তোমার অস্তিত্ব হতে আমিত্বের পত্রপল্লব ঝেড়ে ফেলে দাও, নিজেকে আমিত্বশূন্য নাঙ্গা গাছে পরিণত কর, তাহলে তিনি তোমার ভেতর থেকে এমন আধ্যাত্মিক বসন্তের উজ্জীবন ঘটাবেন, যা তোমার অস্তিত্বের গাছটিকে হাকিকত ও মারেফতের ফলে-ফুলে ভরে দেবে। নৈতিক সৌন্দর্যের সমারোহে জীবন মহিমান্বিত হবে।

হ্যাঁ, যদি তুমি নিজেকে রাতের মতো করে ফেল, নফসে আম্মারার উৎপাত ঠেকাতে পার, যদি কামনা-বাসনা, খ্যাতির লোভ সংরণ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পার, তাতে নিজেকে রাতের আঁধারে আচ্ছাদিত মনে হলেও শীঘ্রই তোমার অন্তর্জগৎ হতে আল্লাহ প্রভাতের দেদিপ্যমান সূর্য উদিত করবেন।

কাজেই হে ময়ূররূপী মানুষ তোমার চেহারাকে কুফরি নাফরমানির নক দিয়ে আঁছড়াবে না, ক্ষতবিক্ষত করবে না। কামনা-বাসনার আধিক্যের কারণে তুমি নিজের আধ্যাত্মিক চেহারা দেখতে পাচ্ছ না। মন্দচিন্তা, মন্দচরিত্র বর্জন কর, তোমার সুন্দর চেহারা তোমার সামনে তখনই উদ্ভাসিত হবে। তোমার ভেতরে আসল যে চেহারা তার পরিচয় ‘নফসে মুতমাইন্না’ প্রশান্ত আত্মা।

রূয়ে নফসে মুতমাইন্না দর জসদ

যখমে নাখোনহা’য়ে ফিকরত মী কশদ

তোমার ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রশান্ত আত্মা যা

তোমার মন্দচিন্তার নখ নিয়ত বিক্ষত করছে তা।

কোরআন মাজিদে নফসে মুতমাইন্নার পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে,

‘হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।’ (সূরা ফজর, আয়াত-২৭, ২৮)

এটিই মানব সত্তার আসল পরিচয়। নফসে মুতমাইন্না বুকের ভেতরে আয়না স্বরূপ। তোমার খারাপ চিন্তা, অসৎ কাজ এই আয়নার উপর কালো দাগের আঁছড় বসিয়ে দেয়।

ফিকরতে বদ নাখোনে পুর যাহর দা’ন

মী খরা’শদ দর তাআম্মুক রূয়ে জা’ন

যত মন্দ চিন্তা জান বিষাক্ত নখ শুধু খামচায়

ক্ষত-বিক্ষত দাগ পড়ে গভীরে রূহের চেহারায়।

বুঝলাম, তুমি চিন্তাবিদ, যুক্তিবুদ্ধিও সারথী, কাল্পনিক প্রশ্নের জট খুলতে ঘুম নাই অহর্নিশ, অথচ তোমার রূহের কী প্রয়োজন, আত্মায় কোথায় জট লেগে আছে, সে চিন্তা নাই। তার পরিবর্তে আজে বাজে চিন্তা দিয়ে রুহের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছ। তোমার এই কাজ স্বর্ণের তৈরি কোদাল নিয়ে মল খসানোর মতোই বেমানান। তুমি থিসিস, এন্টি থিসিস, সেনথিসিস এর মারপ্যাঁচে সমস্যার জট চষে জীবন যৌবন শেষ করে দিয়েছ; আমার প্রশ্ন, তুমি কি নিজের ভেতরে খননকার্য চালিয়েছ? তুমি কি জানতে পেরেছ, তুমি ভাগ্যবান, নাকি হতভাগা? তোমার শেষ জীবন কি সৌভাগ্যময় হবে, নাকি চরম হতাশা তোমার অপেক্ষায় রয়েছে? এককথায় তুমি কি তোমার পরিচয় পেয়েছ। কাজেই আগে নিজের সমস্যার সমাধান কর। জায়েয নাজায়েয, হারাম হালাল নিয়ে তর্কে জড়ানোর আগে চিন্তা কর, তুমি নিজে হালাল কি না। ভেবে দেখ, তোমার ভেতরটা পবিত্র কি না, নাকি অপবিত্র চিন্তা ও চেতনায় হাবুডুবু খাও।

বর মকন পর রা’ ওয়াদিল বরকন আযূ

যাঁকে শর্তে ইন জিহা’দ আমদ আদূ

পেখম ছিঁড়না বরং অন্তর চ্ছিন্ন কর, তা থেকে

কারণ, জিহাদের শর্তই হলো শত্রু থাকতে হবে।

তুমি আধ্যাত্মিক সাধনার নামে তোমার পালক পেখম ছিঁড়ে ফেলবে, তা সঠিক পথ নয়। নির্জন নিরালায় বৈরাগ্য সাধনা ইসলামের পথ নয়। কৃচ্ছ্রসাধনা মানে তো নিজের মনের সাথে, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। যুদ্ধের জন্য পূর্বশর্ত সামনে শত্রু থাকা। তার মানে, তোমার নফস থাকতে হবে। নফসকে মেরে ফেলা যাবে না। তাহলে যুদ্ধটা কার সাথে হবে?

মওলানা রুমির আধ্যাত্মিক দর্শনে সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করে, কাজকারবার ছেড়ে দিয়ে চিল্লায় পড়ে থাকা বা বৈরাগ্য সাধনার কোনো স্থান নেই। মওলানার ছেলে সুলতান ওয়ালাদ যেমন বলেন, ছিল্লা নবী-রাসূলগণের পথ ছিল না, তা বেদাত। হ্যাঁ, নির্জনতা অবলম্বন ভালো যদি বন্ধুরা খারাপ হয়। কিন্তু ভালো বন্ধুদের ছেড়ে নির্জনতা মূর্খতা। কেননা, হাদীসে আছে, আল জামাআতু রাহমাতুন ‘সংঘবদ্ধতার মধ্যেই রহমত’। (মাআরেফে সুলতান ওয়ালাদ, পৃ. ২৯৬) মওলানা অন্যত্র বলেছেন, নির্জনতা চাই পরজনের কাছ থেকে, আপনজনের কাছ থেকে নয়। কম্বল কাঁথা শীতের জন্য এসেছে, বসন্তের জন্য নয়।

কাজেই উপরের বয়েতের ব্যাখ্যা হলো, হে ময়ূর! তোমার পালক পেখম ছিঁড় না, উপড়াবে না। বরং তোমার সুন্দর পেখম থেকে তোমার মনটাই উপড়ে ফেল, বিচ্ছিন্ন করে নাও। বাইরের যুদ্ধ যেমন সামনে শত্রু ছাড়া অর্থহীন, তেমনি আত্মিক জিহাদও নফস না থাকলে অনর্থক। সুফিগণ দারিদ্রের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার অর্থও এটিই। অর্থাৎ সম্পদ অমুখাপেক্ষীতা ত্যাগ করার মানে ফকিরী ও দারিদ্র বরণ নয়, বরং সম্পদ আর মুখাপেক্ষীতার প্রতি আগ্রহ না থাকার মানেই হলো ফকিরি। মওলানা বলেন, তোমার মধ্যে যদি যৌন কামনা না থাকে তাহলে আল্লাহর হুকুমে নিজেকে সম্বরণের তাৎপর্য কী হবে। কোনো দিকে মনের ঝোঁক না থাকলে ধৈর্য ধরার মানে তো হবে অর্থহীন। কাজেই

হীন মকুন খোদ রা’ খসী রোহবান মশো

যাঁকে ইফফত হাস্ত শাহওয়াত রা’ গেরু

সাবধান! খাসি করো না নিজেকে, হইও না বৈরাগী

কারণ, পবিত্রতা তো শাহওয়াত কামনার কাছেই জিম্মি।

কামনাই যেখানে নাই, সেখানে কামনা থেকে পরহেয করার মানে কি? যে লোক মরে গেছে তার সাথে কি যুদ্ধ চলে?

আনফিকূ গোফত আস্ত পস কাসবী বকুন

যাঙ্কে নবুয়াদ খরজ বী দখলে কহুন

দান করো নির্দেশ আছে, তাই কর উপার্জন

কারণ, যথেষ্ট উপার্জন ছাড়া কি দান সম্ভব?

কোরআন মাজিদে নির্দেশ আছে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করো। দান করতে হলে তো অর্থ প্রয়োজন। অর্থের জন্য চাই উপার্জন। কোরআন মাজিদের নির্দেশ হলো, ‘আনফিকু’ তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো। তুমি আয়াতটি এভাবে পড় ‘একসিবু সুম্মা আনফিকু’ তোমরা উপার্জন কর, তারপর আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর। অনুরূপ মহামহিম আল্লাহ যে বলেছেন, তোমরা ধৈর্যধারণ করো। তার মানে তোমার ভেতরে নফসানি কামনা বাসনা থাকতে হবে। তারপরেই সেদিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে।

আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন ‘কুলু’ তোমরা খাও। মানুষের মধ্যে জৈবিক কামনা আসার জন্যেই এই নির্দেশ, তারপর যে বলেছেন, অপচয় করো না।

অর্থাৎ পবিত্রতার চেতনাকে তোমার স্বভাবে পরিণত করো। পানাহার যখন মানুষের মনে কামনা বাসনার আগুন জ্বালায়, তখন অপব্যয় থেকে বাঁচার চেষ্টা আস্তে আস্তে পবিত্রতার চেতনা ও পরহেযগারির স্বভাব জাগায়। কাজেই আল্লাহর এই নির্দেশের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা কর। ‘হে আদম সন্তান!

প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর (বিধি মোতাবেক) পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করবে, আহার করবে, পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা ‘আরাফ, আয়াত ৩১) আমরা তার (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত, ৫৩৬-৫৮৫)

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন CHAYAPATH PROKASHONI.

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত