ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০৪)

ময়ূরের সংলাপে মানবচরিত্রের রহস্য

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ময়ূরের সংলাপে মানবচরিত্রের রহস্য

একজন দিব্যজ্ঞানী এক ময়ূরকে নিজের পেখম উপড়াতে দেখে বললেন, ময়ূর! তুমি তো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েছে! নিজেকে বিভসনা করার এমন অহমিকা কীভাবে দেখাচ্ছ? জানো না, অহংকার পতনের মূল? অহংকার প্রত্যেকের আছে, তাই বলে কি দেখাতে হবে? অহংকারের মতো আরো অনেক কিছু আছে মানুষের অস্তিত্বে। চিন্তা করে দেখ, মানুষের ভেতরে অল্পে তুষ্টি আছে। শ্রম সাধনায় যা পায় তার উপর আল্লাহর শোকর আদায় করার নাম অল্পে তুষ্টি। এর বিপরীতটা হলো লোভ। মানে, যত পাই আরো চাই। সাবধান! লোভের খামচি দিয়ে অল্পে তুষ্টির চেহারা বিক্ষত করো না। আল্লাহর ভয় সুপ্ত আকারে সবার মাঝে আছে। ঔদ্ধত্য দেখালে তাকওয়ার সেই ভয় পর্যদুস্ত হয়ে যাবে। প্রত্যেকের মনের বাড়িতে দানশীলতার সুন্দর একটি আয়না আছে। তার পাশে কৃপণতার মুগুরও আছে। কৃপণতার মুগুর দিয়ে দানশীলতার আয়নাটি ভেঙে দিও না। তোমার ইবাদত-বন্দেগির সুন্দর চেহারা শয়তানির উৎপাতে শ্রীহীন করো না। ময়ূর! তোমার অপরূপ পেখম দিয়ে বেহেশত সাজানো যাবে, সেগুলো উপড়াবে কেন? কীসের দম্ভ পেয়েছে তোমাকে, আমাকে বলো।

হে সাধক! তোমার ভেতরে সুন্দর চরিত্রের সুষমা আছে, সঙ্গে আছে মন্দ চরিত্রের উপাদান। সাবধান, তুমি মন্দ চরিত্র দিয়ে সুন্দর চরিত্র সুষমাকে কলুষিত করবে না। তোমার সৎকর্মগুলো পাখা ও ডানার সাথে তুলনীয়। এগুলোর উপর ভর করেই মানবিকতার আকাশে উড়তে হবে, বেহেশতে পাড়ি জমাতে পারবে।

অমূল্য উপদেশ শুনে ময়ূর তত্ত্বজ্ঞানীর মুখের দিকে একবার ফিরে তাকাল। কথা বলতে পারল না। শুরু করল অঝোর নয়নে ক্রন্দন। সে এখন অনুতপ্ত, ভাষাহারা। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা। অবশ্য ময়ূরের অশ্রুর মাঝেই ছিল তত্ত্বজ্ঞানীর অনেক প্রশ্নের জবাব। অবস্থা দেখে স্বয়ং তত্ত্বজ্ঞানী নিজেও অনুতপ্ত হলেন। হায়! আমি কেন এমন প্রশ্নটি করলাম? কেন তার মনোবেদনার কারণ হলাম? এই কান্নায় দিব্যজ্ঞানীর অন্তরেও তোলপাড় শুরু হলো। কারণ, কান্নার শক্তি অসাধারণ। কান্না যদি অন্তরনিসৃত হয়, সে কান্নার প্রতাপে ঊর্ধ্ব-আকাশ আল্লাহর আরশ কাঁদে। কান্না নির্গত হয় অন্তর হতে, তার সাথে যুুক্ত থাকে আকল। অন্তর ও আকল (জ্ঞানবুদ্ধি বিবেক) এর সম্পর্ক উর্ধ্বজগতের সাথে। এই দুটি এসেছে উর্ধ্বলোক থেকে, মানুষকে দেয়া হয়েছে আমানত হিসেবে। উভয়ে মর্ত্য জগতে এসে দেহের পিঞ্জরে লুকিয়ে আছে নীরবে। উভয়ের উদাহরণ, হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয়ের মতো। হারুত মারুতকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল মানুষের স্বভাব দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন করার জন্য।

পরীক্ষার সুবিধার্থে মানুষকে দেয়া হয়েছে অন্তর ও আকল। পরীক্ষা না দিলে তো পুরস্কার নেই। আর পরীক্ষা দিতে হলে এখতেয়ার চাই। এখতেয়ার মানে ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা। তাই মানুষকে দেয়া হয়েছে এখতেয়ার। ভালো বা মন্দ যাচাই করার শক্তি যাকে দেয়া হয়নি তাকে আল্লাহ পরীক্ষার সম্মুখীন করেন না। কোরআনে যে বলা হয়েছে, আমি তোমাদের পরীক্ষা করব, তাতে প্রকারান্তরে বলে দেয়া হয়েছে, তোমাদের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হলো। ‘যেমনে নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ’- এই যুক্তি মিথ্যা। আল্লাহ যা চান তাই হবে, আমার করার কিছু নাই; অমুক ভালো মানুষ তা আল্লাহর ইচ্ছায়; আমি মন্দ কাজ করছি তাও আল্লাহর ইচ্ছায়- এই দর্শনে শয়তানি আছে, গুমরাহী নিহিত। কারণ, আল্লাহপাক তোমাকে ভালমন্দ বাছাই করার অধিকার দিয়ে পাঠিয়েছেন এই জগতে। তোমাকে অন্তর দিয়েছেন। আরো দিয়েছেন আকল ও বিবেকের নিক্তি।

তোমার ভেতরে লক্ষ্য করো, বিভিন্ন প্রবণতা ও উপাদান আছে। সুযোগ পেলেই সেগুলো আত্মপ্রকাশ করে। তোমার অন্তর্গত উপাদান হয়ত গঠনমূলক চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের প্রভায় বিকশিত হয়। নতুবা তোমার ভেতরকার পশুত্বের স্বভাব তোমাকে জৈবিকতার গহ্বরে নিয়ে যায়। তোমার ভেতরের লুকানো মন্দ স্বভাবের উপমা ঘুমন্ত কুকুর। এই কুকুরের অর্ধেকটা প্রতারণা, বাকি অর্ধেক হিংস্রতা। সুযোগ পায় না বলেই প্রতারক মুখ লুকিয়ে আছে।

সদ চুনীন সগ আন্দরীন তন খুফতে আন্দ

চোন শিকারী নীস্ত শা’ন বেনহুফতে আন্দ

শত শত কুকুর ঘুমায় তোমার ভেতরে যথা

শিকারের সুযোগ নাই তাই লুকায় সেথা। (৬৩৪)

লোভ-মোহ, অহংকার, হিংসা বিদ্বেষ, শত্রুতা, যৌনপ্রবণতা সবার অন্তরে লুকিয়ে আছে। সুযোগ পায় না বলে অলস ঘুমিয়ে কাটায়। মানুষের ভেতরকার ফেরেশতাসুলভ শক্তিগুলো যখন দুর্বল হয়ে পড়ে আর শয়তানি শক্তিগুলো অস্তিত্বের মাঠে মহড়া দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়, তখন এসব ঘুমিয়ে থাকা প্রবণতা ও উপাদান জাগ্রত হয় আর আমাদের জীবনকাল দুর্বিষহ করে তোলে। এ সময়ই দুজন অধিনায়ক আমাদের বাঁচানোর তাগিদে এগিয়ে আসে। আমাদের অস্তিত্বের প্রহরী এই দুই অধিনায়কের একজনের নাম রুহ (আত্মা বা অন্তর), অপরজনের নাম আকল (বিবেক বুদ্ধি)।

আকল বা’য়দ নূর দেহ চোন আ’ফতাব

তা’ যনদ তীগী কে নাবওয়াদ জুয সওয়া’ব

আকল চাই আলো বিকিরণকারী সূর্যের মতো

যেন সে নিত্য সত্য সঠিক পথে তরবারি চালায়। (৬৫৮)

তবে এ আকল হতে হবে তীক্ষè, প্রখর। সূর্যের মতো আলো বিকিরণকারী, সত্য ও সুন্দরের দিশারী। আকল যদি পানি ও কাদার পৃথিবীতে স্বার্থ শিকারি হয়, কেবল যদি দুনিয়াকে লুটেপুটে খাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, তাহলে তো মানব জীবনে সত্য ও সুন্দরের কাণ্ডারি হতে পারবে না। যদি এমন আকল তোমার না থাকে, হৃদয়ের আলো দিয়ে সত্য ও সুন্দরকে দেখার দিব্যদৃষ্টি যদি লাভ করতে না পার, তাহলে তুমি কী নিয়ে এত বড়াই করো?

এ অবস্থায় তুমি নিজেকে সঁপে দাও আল্লাহর কাছে। সেখানে নুরের দরিয়ায় হাবুডুবু খাওয়ার চেষ্টা কর। আল্লাহর নুরের কথা বলছি। এই নুরধার করা নয়, সূর্যের আলোর মতো নিজস্ব। আবার সূর্য চন্দ্রের আলোর মতোও নয়; সূর্যের কিরণ, চাঁদের আলো দেয়ালের উপর পতিত হয়, তার ছায়া আছে, সরে যায়। এক পর্যায়ে বিলীন হয়ে যায়; কিন্তু আল্লাহর নূরের ছায়া নাই, কোথাও সরে যায় না, বিলীন হয় না। সমগ্র জগতে যে সৌন্দর্য বিরাজিত তা সেই নূরের ঝলক। চাঁদ সূর্যও আলো পেয়েছে সেই নূরের দ্বীপাধার থেকে। সৃষ্টিলোকের নানা প্রপঞ্চ সামনে আছে, এখানে সূর্যের কিরণ চোখে লাগে, চাঁদের জ্যোছনা হৃদয়ে শান্তির পরশ বুলায়, তাই সেই নুর দেখার সাধ্য কারো নেই। পরকালে এসবকিছু দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে। ফলে তার হাকিকি নুর বান্দার চোখে দেদিপ্যমান হবে। দেখতে পাবে, দুনিয়াতে যার যত কিছুর মালিকানা ছিল এখানে কিছুর অস্তিত্ব নাই। এখানে সবকিছুর মালিকানা একা আল্লাহর।

দিব্যজ্ঞানীর উপদেশ শুনে ময়ূর সম্বিত ফিরে পায়। বিনয়ের সাথে তার প্রশ্নের জবাব দেয়। আমি আমার পেখম ছিঁড়ে ফেলছি, কারণ; আমি চাই না এগুলো আমার আর তার মাঝে আড়াল হোক। চাঁদের আলো প্রথমে পতিত হয় মেঘের গায়ে। দেখা যায়, মেঘমালা জোস্ন্যার চাদর গায়ে শুয়ে আছে আকাশে। আমি মেঘে জোস্ন্যার ঝিলিমিলি নিয়ে ব্যস্ত হতে চাই না। আমি মেঘমালা অতিক্রম করে সরাসরি চাঁদের চেহারার রূপ দেখে মুগ্ধ হতে চাই।

বর কনম পর রা’ ওয়া হুসনাশ রা’ যে রা’হ

তা’ বেবীনম হুসনে মা’হ রা হাম যে মা’হ

তাই তো পেখম উপড়াই, চাই না রূপের বাহার

চাঁদের কাছ থেকেই পান করতে চাই চাঁদের সুধা ।

আমার পেখম সৌন্দর্যের অলঙ্কার, দুনিয়ার ভোগের সামগ্রির প্রতীক। এগুলো মাধ্যম। এগুলো নিয়ে আমি মোহাচ্ছন্ন থাকতে চাই না। কারণ, যারা মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে তারা গোমরাহ হয়েছে। কার্যকারণ তত্ত্বের মারপ্যাঁচে পরম সত্তার পরিচয় থেকে তারা বঞ্চিত। তারা প্রতীক পূজায় লিপ্ত হয়েছে, প্রতীমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তিনিই যে আসল কার্যকারণ, তার হাতেই যে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ সে কথা ভুলে গেছে। যুগে যুগে এরাই অংশীবাদিতা ও শিরকে পতিত হয়েছে। ত্রিত্ববাদ বহুত্ববাদের প্রাদুর্ভার মানব সভ্যতায় এভাবেই বিস্তৃত হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, তাহলে কি তিনি ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হওয়া যাবে না? রুহের পুষ্টির জন্য কি দেহকে ধ্বংস করতে হবে। না, কথা সেটা নয়। দেহ থাকতে হবে। তবে তা রুহের শাসনের অধীনে থাকতে হবে। আমার বাইরের পেখম, এগুলো আমার জন্য নয়, অন্যদের জন্য। আমার জিনিস হলো আমার এই মাথা। এই মাথা তিনি ছাড়া কারো কাছে নত হয় না, সেজদায় লুটায় না। মাথায় আমার চোখ আছে, মস্তিষ্ক আছে, মুখ আছে, গোটা দেহের নিয়ন্ত্রণ এখান থেকে। আবার মাথার নিয়ন্ত্রণ রুহের হাতে। রুহ যেদিকে চায় মাথার চিন্তা সেদিকে যায়। এ কারণে আমার রুহে কেবল তার ভালোবাসাই লালন করি। তার মোকাবিলায় আর কারো ভালোবাসা এই অন্তরে নেই। হে সাধক! তুমি দুনিয়ার লোভ-লালসার পেছনে নিজের রুহকে, আত্মিক চেতনাকে, মন ও মস্তিষ্ককে কলুষিত করো না। হয়ত মনে হবে, এর কারণে তুমি অসহায়, গরিব। কিন্তু দুনিয়া পূজারীদের পেছনে নিজের ব্যক্তিত্ব, মানবিক চেতনা উজাড় করার পরিবর্তে দারিদ্রের জীবন অনেক উত্তম। এই অর্থেই নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ফকীরী আমার গর্বের ধন’। গুপ্তধন কোথায় গচ্ছিত রাখা হয়? নিশ্চয়ই বিরানভূমিতে। কারণ বিরানভূমির অবস্থান, দুনিয়াদার লোভী মানুষের নাগালের বাইরে। আমার পেখম ছিঁড়ে ফেলছি, যাতে নিরাপদ থাকতে পারি দুনিয়াপূজরির উৎপাত হতে। আমরা তার (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত, ৬০৮-৭১৮) মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত