মুরগকী আন্দর শেকা’রে কেরম বূদ
গুরবে ফুরসত য়া’ফত উ রা’ দর রূবূদ
একটি পোকা শিকারে মত্ত ছিল একটি পাখি
বিড়াল এসে ছোবল হেনে ছিনিয়ে নিল পাখিটি।
একটি পোকা ধরার জন্য ওঁত পেতেছিল একটি পাখি। সুযোগ বুঝে এক বিড়াল পেছন থেকে ছোবল মেরে পাখিটি ধরে চম্পট দিল। প্রাকৃতিক জগতে এই ঘটনার নজির একটা দুইটা নয়, শতশত, অহরহ। এখানে যে ভক্ষক, সে ভক্ষিতও। পাখি ছিল ভক্ষক। সে অন্যকে খাওয়ার অপেক্ষায় ছিল; কিন্তু মুহূর্তে সে ভক্ষিত হলো। যে শিকারি, সে অন্যের শিকার। বেঁচে থাকার এই সংগ্রাম সর্বত্র। চোর ওঁতপেতে থাকে অন্যের সম্পদ আত্মসাতের জন্য। ওদিকে দারোগা চোর ধরার তল্লাশিতে চক্কর দেয় পুলিশ নিয়ে।
চোরের ধ্যানজ্ঞান মগ্ন আসবাবপত্র কোথায় বা দরোজার তালা খোলার চিন্তায়। অথচ তার খবর থাকে না হাতকড়ার কিংবা গৃহস্থের শেষ রাতের কান্নার। নিজের ধান্ধায় সে এতই মগ্ন থাকে, খেয়াল থাকে না কখন রাতের প্রহরী পুলিশ আসে। প্রাণী জগতের এই অভিজ্ঞতার মতো উদ্ভিদ জগতেও একই নিয়মের ব্যত্যয় নেই।
ঘাস-উদ্ভিদ পানি খায় নরম মাটি চুষে। অথচ সেই ঘাসে উদরপূর্তি করে কোনো প্রাণী এসে। পোকা শিকারি পাখির মতো এই উদ্ভিদও কখনো ভক্ষক, কখনো ভক্ষিত। মহামহিম আল্লাহ ছাড়া জগতের সবকিছু এই নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ। আল্লাহর পরিচয় হলো, তিনিই সবাইকে খাওয়ান, তিনি অমুখাপেক্ষী, তার প্রয়োজন নেই কোনো কিছু খাবারের।
ওয়াহুয়া ইয়ুতইমকুম ওয়ালা ইউতআম চো উস্ত
নীস্ত হক মাকূল ও আ’কেল লাহমো পূস্ত
আল্লাহ তোমাদের খাওয়ান, খান না তিনি কিছুই
তিনি নন ভক্ষিত বা ভক্ষক গোশত ও চর্ম মোটেই।
প্রাকৃতিক জগত, উদ্ভিদ জগতের এই নিয়মকে সামনে রাখলে আল্লাহর পরিচয় তোমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে। প্রাণীমাত্রই এখানে ভক্ষক আবার ভক্ষিতও। কিন্তু আল্লাহ ভক্ষক নন, ভক্ষিতও নন। অস্তিমাংসের সত্তা নন তিনি। কোরআন মজিদে আল্লাহ পাকের এই পরিচয়টি অতি সুন্দরভাবে অঙ্কন করা হয়েছে।
‘বলো, আমি কি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করব? তিনিই আহার্য দান করেন; তাকে কেউ আহার্য দান করে না এবং বলো, আমি আদিষ্ট হয়েছি, যেন আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমি প্রথম ব্যক্তি হই, আমাকে আরো আদেশ করা হয়েছে, তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হইও না।’ (সূরা আনআম, আয়াত-১৪) গভীর নিরীক্ষণে বুঝা যাবে. একমাত্র আল্লাহ ছাড়া প্রাকৃতিক জগতে যতকিছু আছে, তা ভক্ষক হোক বা ভক্ষিত, অন্যের গ্রাসে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে কেউ মুক্ত নয়। আজ যে ভক্ষক, অন্যকে ধরে খাচ্ছে, গ্রাস করছে, সে একদিন অবশ্যই ভক্ষিত হবে, অন্য কেই এসে তাকে গ্রাস করবেই। এই ভক্ষিত হওয়ার বা অন্যের গ্রাসে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকার একটি পথ আছে। তা হল এমন কারো সঙ্গে যুক্ত হওয়া, এমন সত্তার আশ্রয় নেয়া, যার ক্ষয় নেই, লয় নেই, পানাহারের প্রয়োজন যার নেই। সব চাহিদা হতে যিনি সম্পূর্ণ মুক্ত, চিরঞ্জীব। এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল ছোট বেলার এক ওয়াজ মাহফিলের কথা।
আমাদের এলাকার অপ্রতিদ্বন্ধি সুবক্তা ছিলেন মওলানা মোবারক আহমদ। তিনি এখন মরহুম। তার মুখের ভাষা ও বাচনভঙ্গিতে একরকম জাদু ছিল। তিনি এক গল্পের অবতারণা করে বললেন, অমুক জায়গায় এক মাহফিলের সূচনায় ঘোষণা করল, আজকের মাহফিলের সভাপতিত্ব করবেন অমুক ইউনিয়নের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান অমুক। আমি বংলা কমবুঝি, ইংরেজি মোটেও বুঝি না, তবে খেয়ে দেখেছি। শ্রোতাদের চোখেমুখে তখন বিস্মিত জিজ্ঞাসা, ইংরেজি খাওয়ার মানে কী? বললেন, আজ সকালে চা-পানের সময় বিস্কুটের গায়ে লেখা ছিল নাবিস্কো। শ্রোতাদের মাঝে হাসির ঝিলিক। জানতে চাইলাম, ভূতপূর্ব মানে কি? আমাকে জানানো হল, ভূতপূর্ব মানে সাবেক। আরবি দিয়ে বুঝতে হলো বাংলা। আরো পরিষ্কার করে বলা হলো, যিনি আগে কোনো পদে ছিলেন, এখন সেই পদে বহাল নেই তাকে বলা হয় ভূতপূর্ব। বললাম, ইনি আগে অমুক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন এখন চেয়ারম্যান নাই তাই বলে কি ভূত হয়ে গেলেন? তা হলে বুঝলাম, যারা দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত, দুনিয়ার ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতা চলে গেলে দুনিয়ায় থাকতেই তারা ভূত হয়ে যায়। কিন্তু যারা আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত, আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত তারা মরার পরও ভূত হন না; মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাদের জন্য সম্মানের আসন সংরক্ষিত।
তিনি আহ্বান জানালেন, এই মজলিসে এমন বাপের বেটা কে আছে, কার বুকের পাটা আছে? হাজার বছর আগে যিনি ইন্তিকাল করেছেন, হযরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী, তাকে কি কেউ বলতে পারবেন, ভূতপূর্ব বড়পীর বা সাবেক বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী? কারণ, তিনি ছিলেন আল্লাহর অলি। আল্লাহ হলেন অক্ষয় অব্যয় চিরঞ্জীব, আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত ছিল তার সম্পর্ক। এ দুনিয়ায় যারাই আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে, যতবেশি সম্পর্ক মজবুত করতে পেরেছে তিনি ততবেশি অমর। আসুন আমরা দ্বীনের কাজে আল্লাহর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কযুক্ত করি।
ফিরে আসি মওলানা রুমি (রা.)-এর ধারাভাষ্যে। প্রাকৃতিক জগতের মতো আমাদের অন্তর্জগতেও নিত্য বিরাজমান এই ভক্ষক ও ভক্ষিতের নিয়ম। আমাদের মাথায় একটি চিন্তা আসে আবার অন্য চিন্তা এসে সে চিন্তা তলিয়ে নিয়ে যায়। চিন্তার শিকল থেকে কারো রেহাই নাই। নিদ্রার কোলে আশ্রয় নিলে মনে হবে সব চিন্তা বেরিয়ে গেল মনের আকাশ ছেড়ে। ঘুম ভাঙলে আবার চিন্তা চড়াও হয় মনের আঙিনাজুড়ে। ঘুমের মধ্যে চিন্তার হাত থেকে সাময়িক অব্যাহতির উপমা মৌমাছি আর পানি। ক্ষিপ্ত মৌমাছি যখন তোমাকে তাড়া করে, তুমি ডুব দিয়ে আশ্রয় নাও পানির নিচে। কিন্তু কতক্ষণ। মাথা তুললেই আবার মৌমাছির আক্রমণ। তোমার কল্পনার ঘরেও কয়েকটি মৌমাছি এলোপাতাড়ি তড়পায়। তোমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখে একের পর এক চিন্তায়। মানুষের উপর চিন্তার এই আধিপত্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভক্ষকের উদাহরণ। এ ছাড়া আরো কত ভক্ষক আছে, আল্লাহই জানেন তার সংখ্যা কত অগণন।
মওলানা রুমি আরো বলেন, যদি চাও এসব ভক্ষক হতে নিস্তার পেতে। আশ্রয় নাও পরম আশ্রয়দাতার কাছে। আল্লাহপাকের গুণবাচক ৯৯ নামের একটি হাফিজ, সংরক্ষণকারী, আশ্রয়দাতা। তোমার যদি সামর্থ্য না থাকে সেই হাফিজের কাছে যাবার, অন্তত রুজু হও সেই মহান ব্যক্তির, যার উপর ছায়াপাত করেছে আল্লাহর হাফীযুন নামের ঝলক। তিনি হলেন যমানার পীর। তার হাত ছাড়া হাত দিও না কারো হাতে। কেননা, আল্লাহই আপন হেফাযতে নিয়েছেন তাকে। তুমি বলতে পার আমার যে জ্ঞানবুদ্ধি আছে, তা-ই আমাকে পথ দেখাবে। আমার জ্ঞানবুদ্ধি বিবেকই আমার পীর। তোমার এমন চিন্তা সঠিক নয়। কারণ, তোমার যে জ্ঞানবুদ্ধি চিন্তাকে মুর্শিদ ভেবেছ তার স্বভাব তো শিশুসূলভ। নফসের কাছাকাছি থাকতে থাকতে তোমার জ্ঞানবুদ্ধির অবস্থা নাজুক ও ভঙ্গুর। প্রবৃত্তির নানা প্রবঞ্চনার সঙ্গে উঠা-বসার ফলে তোমার জ্ঞানবুদ্ধির উপর অবহেলা, অজ্ঞতা ও কামনার পর্দা ঝেঁকে বসেছে। কাজেই সেই আকল বা বুদ্ধিবিবেকের উপর ভরসা করে পথ চলা তোমার জন্য নিরাপদ নয়। মওলানার পরিষ্কার পরামর্শ-
দস্তে তো আয আহলে বায়আত শওয়াদ
কে ইয়াদুল্লাহ ফাউকা আইদিহিম শওয়াদ
তোমার হাত যুক্ত হোক বায়আত ওয়ালার সঙ্গে
‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর’ হয় যাতে।
তখন তোমার হাত সেসব বায়আতকারীদের হাতের মতো হবে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর’। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমরণ লড়াই করার শপথ নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর হাতে বায়আত করেছিলেন। সেই বায়আতের প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা যখন নবীজির হাতে হাত রেখে বায়আত করছিল, তখন আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর ছিল। (দ্র. সূরা ফাতহ, আয়াত-১০)
মওলানা রুমি বলেন, পীরের হাতে বায়আত গ্রহণের কথা এ জন্যেই বলছি যে, তিনি এ যুগে নবীজির নায়েব। পরিভাষায় নায়েবে রাসূল। কাজেই পীর ধরার আগে দেখতে হবে তিনি নায়েবে রাসূল হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিনা। মসনবি প্রথম খন্ডে মওলানা এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন এভাবে-
চোন বসী ইবলীস আদম রূয় হাস্ত
পস বে হার দস্তী ন শায়দ দা’দ দস্ত
যেহেতু অনেক ইবলিস আছে আদমরূপী
কাজেই যার তার হাতে হাত দেয়া অনুচিত।
মওলানা বলেন, মানুষ যখন কারো হাতে বায়আত গ্রহণ করে, যখন মনে প্রাণে কারো নেতৃত্ব মাথা পেতে নেয়, তখন তার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই সম্পর্ক স্থায়ী হয় এই জগতে ও ঐ জগতে। কাজেই যার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছ, যার নেতৃত্ব মাথা পেতে নিয়েছ আখেরাতে তার সঙ্গেই তোমার হাশর হবে।
এক বেদুইন এসে নবীজিকে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কেয়ামত কবে হবে? নবীজি উল্টা তার কাছে জানতে চান, কেয়ামতের জন্য তোমার কী প্রস্তুতি আছে। বেদুইন সাহাবী আরজ করলেন, কেয়ামতের জন্য নামাজ রোযার বড় সঞ্চয় তো আমার নাই, তবে আমি আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালোবাসি (আমার এটুকুই সম্বল)। নবীজি তখন বললেন, তুমি যাকে ভালোবাস কেয়ামতে তুমি তার সঙ্গেই থাকবে। বুখারী শরীফের বর্ণনায় নবীজির পবিত্র জবানে এই ঘোষণা শুনে মদীনায় ঈদের খুশির জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। কারণ, রাসূলের মহব্বতে বেহেশত এবং বেহেশতে নবীজির সান্নিধ্যের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এই ঘোষণায় ছিল।
গোফত আল মারউ মাআ মাহবুবিহী
লা ইউফাক্কুল কালবু মিন মতলুবিহী
বলেছেন, মানুষ থাকবে প্রিয়জনের সঙ্গে
অন্তর বিচ্ছিন্ন হয় না প্রিয়তমের কাছ থেকে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরীফ, ৫খ. বয়েত-৭১৯-৭২৭) মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন - CHAYAPATH PROKASHONI