ব্যভিচার একটি কবিরা গোনাহ। নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার চূড়ান্ত রূপ। এর ফলে সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে। ধ্বংস হয় সুস্থ জীবন ও সুন্দর পরিবেশ। কোরআনে ব্যভিচারের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সুরা বনী ইসরাইল : ৩২)। আয়াতে ব্যভিচারের নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় এটা কত বড় জঘন্য পাপ।
ব্যভিচারের পরকালীন শাস্তি : প্রকৃত মুসলমানরা শিরক, হত্যা এবং ব্যভিচার থেকে মুক্ত থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত আনুগত্যশীল হওয়ার জন্য ব্যভিচার না করা অন্যতম শর্ত। সুরা মুমতাহিনার ১২ নং আয়াতে নারীদের বায়াত প্রসঙ্গে এ শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যভিচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাহান্নামে তাদের শাস্তি বৃদ্ধি করা হবে।
ইরশাদ বর্ণিত হয়েছে এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গোনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে। কেয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সদা-সর্বদা থাকবে।
(সুরা ফুরকান: ৬৮-৬৯) রাসুল (সা.) ব্যভিচারীদের শাস্তির একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্যে দেখে এসেছেন। সামুরা ইবনে জুনদাব (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসের অংশবিশেষ হলো, রাসুল (সা.) ফেরেশতাদের সাথে সামনে অগ্রসর হয়ে চুলার ন্যায় একটা গর্তের নিকট পৌঁছলেন। গর্তের উপরিভাগ ছিল সংকীর্ণ ও নিচের অংশ প্রশস্ত এবং এর নিচদেশ থেকে আগুন জ্বলছিল। আগুন গর্তমুখের নিকটবর্তী হলে সেখানের লোকগুলোও উপরে চলে আসত যেন তারা গর্ত থেকে বের হয়ে যাবে। আগুন ক্ষীণ হয়ে গেলে তারাও (তলদেশে) ফিরে যায়। গর্তের মধ্যে বহুসংখ্যক উলঙ্গ নারী-পুরুষ ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এরা কারা? তারা বললেন, ওরা ব্যভিচারী। (বোখারি : ১৩০৩)।
পৃথিবীতে ব্যভিচারের শাস্তি : ইসলাম পৃথিবীতে ব্যভিচারের শাস্তির বিধান সুনিশ্চিত করেছে। অপরাধীর স্বীকারোক্তি অথবা চারজন সত্যবাদী চাক্ষুষ সাক্ষীর প্রমাণেরভিত্তিতে এই শাস্তি ইসলামি শরিয়া বা আইন আদালত কার্যকর করবে। জনসাধারণের আইন হাতে তুলে নেয়ার কোনো অধিকার নেই। অবিবাহিত ব্যভিচারীদের প্রকাশ্য একশত বেত্রাঘাত করতে হবে এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর বা জেলবন্দি করতে হবে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশত চাবুক মারবে। তোমরা যদি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখ, তবে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি করুণাবোধ যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (সুরা নূর : ২)। বিবাহিত ব্যভিচারীদের একশত বেত্রাঘাত এবং প্রকাশ্য পাথর মেরে হত্যা করতে হবে। উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আমার কাছ থেকে গ্রহণ করো, তোমরা আমার কাছ থেকে গ্রহণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মহিলাদের জন্য একটি পথ বের করে দিয়েছেন। অবিবাহিত-অবিবাহিতার সঙ্গে ব্যভিচার করে একশ বেত্রাঘাত কর এবং ১ বছরের জন্য নির্বাসন দাও। আর বিবাহিত বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে ব্যভিচার করলে ১০০ বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ (করে হত্যা করবে)। (মুসলিম : ৪২৬৭)।
ব্যভিচার বন্ধে করণীয় : ব্যভিচার বন্ধ করার জন্য ব্যক্তি-পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। ইসলামি আইন জনসম্মুখে কার্যকর করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষার উপকরণ খুঁজে পাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ। মানুষের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থাকলে কেউ ব্যভিচারের পথে পা বাড়াবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাথে জনৈক ব্যভিচার প্রত্যাশী যুবকের গল্প থেকে এটাই বোঝা যায়। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক যুবক রাসুল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহ রাসুল! আপনি আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন! এ কথা শুনে লোকেরা তাকে ধমক দিয়ে বলল, থামো ! থামো! (এ কী বলছো তুমি?) কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে বললেন, আমার কাছে এসো। সে তার কাছে এসে বসলে তিনি তাকে বললেন, তুমি কি নিজ মায়ের জন্য তা পছন্দ কর? সে বলল, না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন।
তিনি বললেন, তাহলে লোকেরাও তো তাদের মায়েদের জন্য তা পছন্দ করে না। অতঃপর তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি তোমার মেয়ের জন্য তা পছন্দ করো? সে বলল, না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন। তিনি বললেন, তাহলে লোকেরাও তো তাদের মেয়েদের জন্য তা পছন্দ করে না। অতঃপর তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি তোমার বোনের জন্য তা পছন্দ করো? সে বলল, না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন। তিনি বললেন, তাহলে লোকেরাও তো তাদের বোনদের জন্য তা পছন্দ করে না। অতঃপর তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি তোমার ফুফুর জন্য তা পছন্দ কর? সে বলল, না! আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন।
তিনি বললেন, তাহলে লোকেরাও তো তাদের ফুফুদের জন্য তা পছন্দ করে না। অতঃপর তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি তোমার খালার জন্য তা পছন্দ কর? সে বলল, না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন। তিনি বললেন, তাহলে লোকেরাও তো তাদের খালাদের জন্য তা পছন্দ করে না। অতঃপর তিনি তার বুকে হাত রাখলেন এবং তার জন্য দোয়া করে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি ওর গোনাহ মাফ করে দাও, ওর হৃদয়কে পবিত্র করে দাও এবং ওকে ব্যভিচার থেকে রক্ষা কর। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর সেই যুবক আর ব্যভিচারের দিকে ভ্রক্ষেপও করেনি। (মুসনাদে আহমদ : ২২২১১, শুআবুল ঈমান : ৫৪১৫)।
ব্যভিচার থেকে মুক্তির উপায় : ব্যভিচার থেকে মুক্তির জন্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই মারাত্মক এই ব্যাধি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। এক. ব্যভিচারের উপসর্গ যেমন প্রেমালাপ, গোপন যোগাযোগ, গায়র মাহরামের সাথে নির্জন বাস, পর্দা লংঘন ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকা।
দুই. ব্যভিচারের কারণে জাহান্নামের যে কঠিন শাস্তি হবে তা স্মরণ করা। তিন. একথা স্মরণ করা যে,আল্লাহ সব কিছুই দেখেন, আমার এ অবস্থাও তিনি দেখবেন এবং কোনো মানুষ এখন না দেখলেও কেয়ামতের ময়দানে সকলের সামনে এটা প্রকাশ করে দেয়া হবে। তখন শরমের অন্ত থাকবে না। চার. বিবাহ না করে থাকলে বিবাহ করা, না পারলে রোজা রাখা। আর স্ত্রী থাকার পরও কোনো নারীর প্রতি খাহেশ হলে এই চিন্তা করা যে, তার যা আছে আমার স্ত্রীর মধ্যেও তা আছে, তাহলে অহেতুক কেন তার প্রতি ঝুঁকতে হবে? পাঁচ. ব্যভিচারের খাহেশ প্রবল হলে সুরা ইব্রাহিমের ২৭ নং আয়াত তিনবার পড়ে শরীরে ফুঁক দেয়া। ছয়. যে নারীর সঙ্গে ব্যভিচারের কামনা জাগে বা যে পরিবেশে জিনার সুযোগ সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে দূরে সরে যাওয়া। সাত. যে বুযুর্গের প্রতি ভক্তি আছে তার সম্পর্কে নির্জনে কিছুক্ষণ বসে এই কল্পনা করবে যে, তিনি আমার অন্তরের মধ্যে বসে আমার অন্তর থেকে সব জঞ্জাল ধরে ধরে বাইরে নিক্ষেপ করছেন। আট. যে সব কথা শুনলে, যেখানে গেলে বা যা দেখলে কিংবা যা পড়লে অথবা যা চিন্তা করলে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বা জিনার মনোভাব জাগ্রত হয় তা থেকে বিরত থাকা। (আহকামে জিন্দেগী : ৬০৫)।