ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০৭)

চাকচিক্য নয়, চাই বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
চাকচিক্য নয়, চাই বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ

সুলতান মুহাম্মদ খারেযমশাহ সাবযাওয়ারে অভিযান পরিচালনা করেন। তার সৈন্যবাহিনী কঠিন অবরোধ সৃষ্টি করে সাবযাওয়ারের বাসিন্দাদের উপর। ইরানের সাবযাওয়ার অঞ্চল ছিল রাফেযি অধুষ্যিত। কঠিন অবরোধের কবলে রাফেযিরা অনুনয়-বিনয় করে সুলতানের কাছে জানমালের নিরাপত্তার আর্জি জানায়। রাফেযি রফয ধাতু থেকে উদ্ভুত। রফয মানে ত্যাগ করা, বর্জন করা। যারা যুদ্ধ ও কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের নেতাকে নিঃসঙ্গ ত্যাগ করে তাদের রাফেযি বলা হয়। রাফেযিরা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (র.) এর খেলাফত অস্বীকার করে। এ জন্য তারা ইতিহাসে রাফেযি নামে চিহ্নিত। রাফেযিরা সুলতানের কাছে নতমস্তক হয়ে প্রাণ ভিক্ষা চায়। ধন-রত্ন স্বর্ণ-রৌপ্য যা ছিল সবই তার খেদমতে সমর্পণ করে। সবার একটিমাত্র আর্জি, আপনি আমাদের প্রাণভিক্ষা দিন। বিনিময়ে স্বর্ণরৌপ্য যা আছে সব নিন। প্রত্যেক মওসুমে যত চান খাজনা দেব, আপনার রাজদরবারে দিয়ে আসব। তবু গণহত্যার হাত থেকে আমাদের প্রাণ বাঁচান। আপনার বদান্যতার কাছে আমাদের এই আবদার, ফেরত দেবেন না, হে মহিয়ান।

সুলতান মুহাম্মদ খারেযমশাহ বললেন, তোমরা যতই বিনয় দেখাও, আমার পাকড়াও থেকে তোমাদের রক্ষা নেই। তবে একটি শর্তে আমি তোমাদের নিরাপত্তা দিতে পারি। তা হলো তোমাদের এই এলাকা থেকে এমন কোনো লোক আমার সামনে হাজির করতে হবে, যার নাম আবু বকর। কিন্তু রাফেযিদের সমাজে আবু বকর নামের লোক কীভাবে পাওয়া যাবে। সুলতান ঘোষণা দিলেন, অন্যথায় আমি তোমাদের কচুকাটা করে ছাড়ব। তারপর বিরাট অংকের খাজনার বোঝা বহন করতে হবে তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। কাকুতি-মিনতির ভনিতা দেখিয়ে লাভ হবে না আমার কাছে। এরিমধ্যে চারদিক থেকে লোকেরা স্বর্ণরৌপ্যের উপহার নিয়ে হাজির হলো সুলতানের দরবারে। তাদের সবার একই কথা, জাহাঁপনা! আমাদের যত ধন-সম্পদ আপনার জন্য উৎসর্গিত। কিন্তু আবু বকর নামের লোক হাজির করার কঠিন হুকুম থেকে মাফ চাই। আমাদের মাঝে আবু বকর নামে কোনো লোক থাকা তো পুকুরের তলায় শুষ্ক মাটি পাওয়ার মতো অসম্ভব।

সুলতান সাবযাওয়ারবাসীর স্বর্ণরৌপ্যের স্তূপের দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বললেন, তোমরা আমাকে বাচ্চা পেয়েছ নাকি? হাতে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চাও। আমার একটিই হুকুম, হয় তোমাদের এলাকার কোনো আবু বকরকে হাজির করবে, নতুবা আমার খড়কের সামনে গর্দান প্রস্তুত রাখবে। অগত্যা সাবযাওয়ারবাসী দলে দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল আবু বকর নামে মানুষের খোঁজে। চেনা অচেনা লোক ধরে নাম জিজ্ঞাসা করে শহর গ্রামে। দেখা গেল, দূরে মুসাফিরদের সরাইখানার পাশে বিরান ভূমিতে জীর্ণশীর্ণ এক লোক পড়ে আছে। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে বলল, আবু বকর। সবাই চমকে উঠল নামটা শুনে। আবু বকর বলল, এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি। কেউ খোঁজ নেয় না। অনাদর অবহেলায় আমার এই দুরবস্থা। আবু বকরকে নিয়ে উৎসবের আমেজে হৈচৈ তখন চারদিকে। তাকে জানানো হলো, স্বয়ং সুলতান আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। চলুন, আপনি গেলে নিজে খেলাফত পাবেন আর আমরা শহরবাসী গণহত্যার হাত থেকে রেহাই পাব। আবু বকর বলল। কী বল তোমরা? কীভাবে আমি যাব। হাঁটার শক্তিই যদি থাকত তাহলে তো এই দুশমন এলাকা অনেক আগেই ছেড়ে যেতাম। আমি তো এখন চলৎশক্তিহীন। কালবিলম্ব না করে লোকেরা নিয়ে আসল লাশ বহনের খাটিয়া। আবু বকরকে খাটিয়ায় নিয়ে ছুটে চলল সুলতানের দরবারে। মওলানা রুমি এখন বলেন, আমি যে সাবযাওয়ারের কথা বলেছি তা তো এই দুনিয়া। এখানে যারা আল্লাহর পুরুষ, আল্লাহওয়ালা তাদের অবস্থা করুণ। তারা অজ্ঞাত পরিচয়। খারাযেম শাহের কথা বলেছি তিনি তো মহামহিম আল্লাহর প্রতীকী নাম। তিনি হতভাগা মানুষের কাছ থেকে ধন-সম্পদ চান না। মানুষের কাছে মানুষের দিলটাই চান। আবু বকর সেই দিলের প্রতীক।

সবযাওয়ার আস্ত ইন জাহান ও মর্দে হক

আন্দরীন জা’ যায়ে‘ আস্ত ও মুমতাহাক

সাবযাওয়ার হল এই জগত আর আল্লাহওয়ালারা

এই জগতে অসহায় মর্যাদহীন অজ্ঞাত পরিচয় তারা।

হাস্ত খা’রেযামশাহ ইয়াযদা’নে জলীল

দিল হামি খা’হাদ আয ইন কওমে রযীল

খারেযামশাহ বলতে তো উদ্দেশ্য মহান প্রভু

হতভাগা মানুষের কাছে তিনি চান অন্তর শুধু।

সবযাওয়ার, আবু বকর, সুলতান খারেযমশাহ এখানে রূপক ও প্রতীকী উপমা। সাবযাওয়ার মানে এই জগত। আবু বকর মানে মানুষের স্বচ্ছ অন্তর কিংবা আল্লাহর নেক বান্দারা, যাদের দেখলে দুনিয়াবী বিচারে পদণ্ডপদবির অধিকারী লোক বলে মনে হয় না। তারা সাদাসিধা সরল অজ্ঞাত পরিচয়। আর খাারেযম শাহ বলে মহামহিম আল্লাহতায়ালার কথাই বুঝানো হয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষের কাছে কী চান? ধন-সম্পদ, স্বর্ণরৌপ্য? নাকি অন্যকিছু। হ্যাঁ, বান্দার স্বচ্ছ নির্মল অন্তরটাই তিনি চান। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি (মানুষের) কোনোই কাজে আসবে না। সেদিন লাভবান হবে কেবল সে ব্যক্তি, যে (গুনাহমুক্ত স্বচ্ছ নির্মল) বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আল্লাহর নিকট আসবে।

(সুরা শোয়ারা, আয়াত-৮৮, ৮৯)। কুরআন মজিদের এই বাণীকে হাদিস শরিফে আরো সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন প্রিয় নবীজি। মওলানা রুমির ভাষায়-

গোফত লা’ ইয়ানযুর ইলা’ তাসবীরেকুম

ফাবতাগু যাল কালবে ফী তাদবীরেকুম

বলেন, তিনি দেখেন না তোমাদের অবয়ব ছবি

কাজেই কাজেকর্মে খুঁজে নাও অন্তরওয়ালা যিনি।

এ বয়েতের প্রথম লাইনে একটি হাদিসের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়েছে। নবীজি ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক বেশভূষা ও ধন সম্পদের দিকে তাকান না; বরং তিনি তোমাদের অন্তকরণ ও বাস্তব কর্মের দিকে তাকান।’ অর্থাৎ তোমাদের মনের স্বচ্ছতা ও বাস্তব আমলই আল্লাহর কাছে বিবেচ্য, তোমাদের ধন-সম্পদ বাহ্যিক বেশভূষা নয়।

বয়েতের পরের লাইনে মওলানা তার নিজস্ব জীবন দর্শনটি ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কেউ যদি নিজে স্বচ্ছ নির্মল অন্তকরণের অধিকারী হতে না পারে, তাহলে যদি অন্তত কোনো অন্তরওয়ালা বুযর্গের সাহচর্য গ্রহণ করে তাতে অন্তরের স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা অর্জন করতে পারবে। প্রাণহীন ইবাদত বন্দেগী দিয়ে কেউ আত্মিক উন্নতির উচ্ছ মার্গে পৌঁছতে পারবে না বিধায় একজন পথ প্রদর্শকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কোরআন মজিদের নির্দেশ হলো, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসুলের আনুগত্য কর আর তোমাদের মধ্যকার উলুল আমর এর আনুগত্য কর।’ মওলানা রুমির জীবন দর্শনে সেই উলুল আমরের ভূমিকায় রয়েছেন স্বচ্ছ অন্তঃকরণের অধিকারী অলি আল্লাহ। মওলানা বলতে চান, আল্লাহওয়ালা বুযর্গের আনুসরণের মধ্য দিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য উদ্ভাসিত হবে। কেননা, আল্লাহ বলেন,

মন যে সাহেবদিল কুনাম দর তো নযর

নেই বে নকশে সাজদা ও ইসারে যর

অন্তরওয়ালার দৃষ্টিতে দেখব আমি তোমার দিকে

বিচার করব না সজিদার আকৃতি ও স্বর্ণ বিলানো দেখে।

যারা আল্লাহর পুরুষ তারা তোমাকে কোন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করের আল্লাহর কাছে তা বিবেচ্য। কারণ, ইবাদত-বন্দেগীর আকার আকৃতি ও দান-দক্ষিণায় কপট লোকেরাও চমৎকারিত্ব দেখাতে পারে। এ কারণেই উলুল আমর বা যমানার অলি বা ইমামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি আমিরের আনুগত্য ত্যাগ করল এবং মুসলমানদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তার মৃত্যু হয়েছে জাহেলিয়াতের উপর।’ কাজেই দ্বীনের সঠিক পথে অবিচলতার জন্য একজন আল্লাহওয়ালা বুযর্গের সাহচর্য গ্রহণ করতেই হবে।

মওলানা রুমি (র) আরো বলেন, তুমি নিজেকে অন্তরওয়ালা বলে ধারণা করেছ। এ কারণেই কোনো অন্তরওয়ালাকে খোঁজ করার প্রয়োজনীয়তা তুমি অনুভব করো না। হাকিকতের দিল তো সেই দিল, যার মধ্যে উর্ধ্ব আসমানের মতো ২৭ আসমানও প্রবেশ করলেও হারিয়ে যাবে। তুমি ছোটখাট এসব দিলকে দিল বলো না। সাবযাওয়ারে আবু বকরকে সন্ধান করে পাবে না। যে অন্তরওয়ালার কথা বলছি তার অন্তরটা ছয়মুখি আয়নার মতো। আল্লাহর সরাসরি নজর পতিত তার উপর।

আসমানী ফয়েয বিতরণ হয় সেখান থেকে। এই জগতে ও তোমার জীবনে তার ভূমিকা মূল্যায়নের জন্য একটি হাদিসের মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা কর। বেহেশতের মালিক আল্লাহ সত্য; কিন্তু সন্তানের জন্য মা-বাবা সেই বেহেশতের উপলক্ষ। বলেছেন, মা-বাবার পায়ের নিচে (তাদের খেদমতের বিনিময়েই) সন্তানের বেহেশত নসীব হবে। এখানে মা-বাবা যেমন সন্তানের বেহেশত লাভের উপলক্ষ, জীবন জগতেও উলুল আমর বা অন্তরওয়ালা অলি আসমানি ফয়েয বিতরণের যোগসূত্র।

বিষয়টির গভীরতর পর্যালোচনার জন্য মূল মসনবির স্মরণ নিতে হবে। সে যাই হোক, হে সাধক! তোমার একটি দিল চাই স্বচ্ছ-নির্মল-বিশুদ্ধ। সকল দিলের যিনি মালিক, তিনি সেই দিলের জন্য অপেক্ষারত।

আয বরা’য়ে অন দিলে পুরনূর ও বির

হাস্ত অন সুলতানে দিলহা মুন্তাজির

নূরে ভরপুর স্বচ্ছ তোমার দিলের জন্য শোনো

সকল দিলের বাদশাহ এখন অপেক্ষমাণ জানো।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-৮৪৫-৮৮৮)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে- ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত