ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শয়তানের ধোঁকার বিচিত্র ফাঁদ

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
শয়তানের ধোঁকার বিচিত্র ফাঁদ

আদি পিতা হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর আল্লাহতায়ালা জ্ঞানের পরীক্ষা নেন আদম (আ.) ও ফেরেশতাদের কাছ থেকে। সে পরীক্ষায় আদম (আ.) উত্তীর্ণ হন আর পরাস্ত হন ফেরেশতারা। আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ দেন তোমরা সবাই আদমকে সেজদা কর। সব ফেরেশতা আল্লাহর আদেশে সেজদা করল আদমের সামনে। কিন্তু ফেরেশতা সর্দার ইবলিস করল না। সে ছিল বর্ণচোরা জিন বংশোদ্ভুত। মানুষ আসার আগে পৃথিবীতে হানাহানি, রক্তপাত, অরাজকতা সৃষ্টি করলে ফেরেশতাদের দিয়ে জিনদের বিতাড়িত করা হয় লোকালয় থেকে। তখন কৌশলে জিন আজাজিল খোলস পাল্টে ফেরেশতাদের দলে ভিড়ে যায়। আদমকে সেজদার প্রশ্নে সে বেঁকে বসে। বলে, মাটির স্বভাব নিম্নমুখী হওয়া, অধোগতি। আগুনের স্বভাব উর্ধ্বগতি হওয়া, অগ্রগতি। কাজেই আমি তো নিম্নমুখী হতে পারি না। মান ইজ্জত খুইয়ে স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করতে পারি না। আল্লাহর সাথে যুক্তিতর্কের বেয়াদবির কারণে তাকে বিতাড়িত করা হয় আল্লাহর রহমত হতে। পরিণত হয় অভিশপ্ত শয়তানে। আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সে চিল্লাপাল্লা শুরু করে। অভিযোগের আঙুল তুলে স্বয়ং আল্লাহর দিকে। তুমিই তো আমাকে পরীক্ষার মুখে ধোঁকায় ফেলেছ। তোমার নির্দেশ তো ছিল, আমি ছাড়া আর কাউকে সেজদা করবে না। আদমকে সেজদার হুকুম দিয়ে আমার পরীক্ষা নিয়েছ। সেজদা করলে বলতে যে, অন্যকে কেন সেজদা করেছ?

আর এখন সেজদা না করায় শাস্তি দিয়েছ, অভিশপ্ত ও বিতাড়িত করে। আমি তোমার সামনে প্রমাণ করতে চাই, আমার মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হলে অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হবে, শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও বিতাড়িত হবে। তোমার ইজ্জতের কসম আমি ওদের দেখে নেব, সবাইকে গোমরাহ করে ছাড়ব। তার মানে ইবলিস নিজের ভুল স্বীকার করার পরিবর্তে ঔদ্ধত্য দেখাল।

আল্লাহ বললেন, ঠিক আছে তোমাকে অবকাশ দিলাম। আমার খাস বান্দাদের তুমি কীভাবে গোমরাহ করতে পার, তা আমি দেখব। ইবলিশ বলল, হ্যাঁ, তোমার মুখলেস বান্দাদের আমি পথহারা করতে পারব না। কিন্তু বাকিদের আমি রেহাই দেব না। তুমি যেহেতু অবকাশ দিয়েছ, মানুষকে ধোঁকায় ফেলার ফাঁদগুলো আমার হাতে দিতে হবে। সেই ফাঁদে আমি মানুষকে জব্দ করব। আল্লাহ ইবলিসকে দেখিয়ে বললেন, এই যে স্বর্ণরৌপ্য, ক্ষমতা অশ্বরাজি। এগুলো তুমি ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতে পার। ইবলিস বলল, ধন্যবাদ প্রভু! তবে চেহারাটা ফ্যাঁকাশে করে আরো কিছু চাই বলে ভাব দেখাল।

আল্লাহ বললেন, খনির স্বর্ণরৌপ্য নয়; রত্ন অলঙ্কার হীরা জহরত দিলাম, সেগুলোর লোভের ফাঁদে তোমার দলের লোকদের ভিড়াতে পারবে। কারা অন্তর দিয়ে আমাকে ভালোবাসে আর কারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতায় মজে থাকতে চায় পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইবলিস বলল, প্রভু হে! ধন্যবাদ। আমাকে আরো কিছু দিতে হবে, তবেই তাদের তুমি পরীক্ষা করতে পারবে। আল্লাহ বললেন, সুস্বাদু খাবার, দামি পানীয়, আভিজাত্যের পোশাক, এগুলো সরঞ্জাম হিসেবে তোমাকে দিলাম। ইবলিস বলল, এসব হাতিয়ারের বাঁধন অবশ্যই মজবুত; তবে তোমার প্রেমাসক্ত বান্দারা একটি মোচড় দিলেই যাবতীয় বেড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

তোমার কাছে আমি এমন ফাঁদ চাই, যা বড় বড় লোকদের কুপোকাত করতে পারবে। আল্লাহ পাক তখন যন্ত্রসংগীত আর যৌনকামনা মিশ্রিত গানবাদ্য এর কথা বললেন। ইবলিস শুনে মুচকি হেসে বলল, এগুলো তো ঠিক আছে; কিন্তু আমি এমন ফাঁদ চাই, যেখান থেকে বড় ছোট, ভালো মন্দ কারো নিস্তার নাই। আল্লাহতায়ালা তখন নারীর রূপ-ঐশ্বর্যের কথা বললেন। পুরুষের ধৈর্য ও জ্ঞানবুদ্ধি হরণ করার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার দ্বিতীয়টি নেই। প্রস্তাব শুনে ইবলিসের আনন্দ দেখে কে? উল্লম্ফন করে বলে, এই অধিকারটি খুব শিগগির তোমার কাছ থেকে পেতে চাই। নারীর রূপের বাহার, ঢুলোঢুলো চোখের চাহনীর আগুনে সিংহদিল পুরুষের অন্তরও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। চাঁদনি মুখের হাসি, আকিক পাথরে মোড়ানো ঠোঁট, যুগল ভ্রুতে সন্ধ্যাকাশের মায়ার আবহ, গন্ডের তিল, টোল, রূপের ঝিলিক, দেখলে মনে হবে আল্লাহর সৃষ্টিসৌন্দর্যের সবটুকু উঁকি দিচ্ছে নারীর ভেতর থেকে। আজন্ম শত্রু মানুষকে বিপদগামী করতে আল্লাহর কাছ থেকে এসব হাতিয়ার ব্যবহারের অধিকার চেয়ে নেয় ইবলিস। বলল, আমি তাদের বামণ্ডডান দিক থেকে, রগে রেশার ধমনিতে ঢুকে আক্রমণ চালাব। বড় বড় লোককে ধরাশায়ী করব।

কোরআন মাজিদে এর বিবরণ এরূপ : ‘সে (ইবলিস) বলল, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও। তিনি (আল্লাহ) বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে, তুমি অবশ্যই তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে। সে (আরো) বলল, তুমি আমাকে শাস্তি দান করলে এই জন্য আমিও তোমার সরল পথ হতে মানুষ (কে বিপথগামী করা)’র জন্য নিশ্চয়ই ওঁতপেতে থাকব। অতঃপর আমি তাদের কাছে আসবই তাদের সম্মুখ, পেছন, ডান ও বাম দিক থেকে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না। তিনি (আল্লাহ) বললেন, এই স্থান হতে ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও। মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই।’ (সুরা আরাফ, আয়াত-১৪-১৮)।

আয়াতের বর্ণনায় পরিষ্কার যে, ইবলিস মানুষকে গোমরাহ করার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে সুযোগ চেয়ে নেয়। আল্লাহ পাক ভালো লোকদের থেকে মন্দ লোকদের ছাঁটাই করার জন্য ইবলিসকে এই অধিকার দেন। ইবলিস আল্লাহর কাছ থেকে এমন ক্ষমতা লাভ করে যা দিয়ে সে মানুষের সামনে, ডানে ও বামের দিক থেকে আক্রমণ শাণাতে পারবে। এই অধিকারের আওতায় ইবলিসকে মানুষের রক্ত চলাচলের সাথে মিশে এই আক্রমণ করার ক্ষমতাও দেয়া হয়। ফলে যারা ইবলিসের প্রতারণার শিকার হবে তারা ইবলিসের দলীয় কর্মী হিসেবে গণ্য হবে, পরিণতিও হবে ভয়াবহ।

তবে আল্লাহ পাক পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন যে, যারা মুখলেস বান্দা, যাদের কাজেকর্মে আল্লাহর ভয় ও মহব্বত, দ্বীনের স্বার্থ ছাড়া অন্যকিছু নেই, তাদের আক্রমণ করে কাবু করার ক্ষমতা ইবলিসকে দেয়া হয়নি। কারণ, তারা শয়তানের আক্রমণের পথগুলো আগে থেকে বন্ধ করে রাখবে। শয়তানের মোকাবিলায় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সুরা হিজরে পুরো ঘটনার বিবরণ এরূপ’ ‘ফেরেশতারা সবাই একত্রে (আদমকে) সেজদা করল; ইবলিস ব্যতীত, সে সেজদাকারীদের সাথে শামিল হতে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলিস! তোমার কী হলো যে, তুমি সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না। সে বলল, তুমি যে মানুষকে গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছ আমি তাকে সেজদা করতে পারি না।”

(আদম মাটির তৈরি আর ইবলিস আগুনের তৈরি- এই অহঙ্কার তার পথের কাঁটা হলো। আল্লাহর হুকমের সামনে যুক্তিতর্ক করে বেয়াদবে পরিণত হলো। বেয়াদবি আল্লাহর রহমত হতে তাকে বঞ্চিত করল।) আল্লাহ বললেন, তাই যদি হয়, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি তো অভিশপ্ত এবং কর্মফল-দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল অভিশাপ। (ইবলিস আরো বেশি জেদ ধরল।) বলল, হে আমার প্রতিপালক! (আমি আদমকে দেখে নেব। তার কারণে আমার এমন দুর্গতি) আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দাও। আল্লাহ বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে- তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে, অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। (আদম সন্তানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে) ইবলিস বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যে আমাকে বিপদগামী করলে তার জন্য আমি মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভন (মনোলোভা) করে তুলব এবং আমি ওদের সবাইকে বিপথগামী করব। তবে ওদের মধ্যে তোমার নির্বাচিত বান্দাদের ব্যতীত।

আল্লাহ বললেন, এটিই আমার নিকট পৌঁছার সরল পথ। (তোমার ধোঁকা প্রতারণা প্রতিহত করে যারা একান্তভাবে আমার দিকে ধাবিত হবে, তারাই আমার। তাদের আমার কাছে টেনে নেব। এটিই আমার সান্নিধ্য লাভের পথ। (মনে রাখবে) বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনো ক্ষমতা চলবে না।’ (সুরা হিজর, আয়াত-৩০-৪২) নারীর রূপসুধা দিয়ে শয়তান শিকার ধরার বর্ণনা দিতে গিয়ে মওলানা রুমির চেতনায় ভেসে উঠে মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর কাঠামো দিয়ে সৃষ্টির রহস্যটি।

তিনি কোরআন মাজিদের দুটি আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে এক দীর্ঘ দার্শনিক আলোচনার অবতারণা করেন। মূল মসনবিতে যাওয়া ছাড়া এখানে এই আলোচনার কুলকিনারা করা যাবে না। আয়াত দুটির ভাষ্য, আল্লাহ পাক বলেন, আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে, অতঃপর আমি তাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি- কিন্তু তাদের নয়, যারা মোমেন ও সৎকর্মপরায়ণ; তাদের জন্য তো আছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।‘ (সুরা তীন, আয়াত-৪-৬)।

যৌবনে সুন্দরের সমারোহ আসে মানুষের দৈহিক গড়নে। বার্ধক্যে জরাগ্রস্ত হয় তার কাঠামো। সাধারণ এই ব্যাখ্যার অন্তরালে মওলানা বিশ্লেষণ করেন, যে আদমকে ফেরেশতারা সেজদা করল, কী হলো যে, সেই ফেরেশতারাই জান্নাত থেকে তাকে বের করে দিল। যৌবনের বসন্তের পরক্ষণে শীতের প্রকোপ কেন নামল মানব বাগানে? আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে। স্থায়ী বাসভবন বেহেশত দেখানোর পর পাঠানো হয়েছে ফিল্ডে। মওলানা রুমি আরো বলেন, যৌবনের পর বার্ধক্যের প্রতিটি চিহ্ন তোমার মৃত্যুর দূত হয়ে তাগাদা দিচ্ছে পরকালের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করার জন্য। তবে এই সৃষ্টি বৈচিত্র্যে পরম সত্য কথাটি হলো, যদি আল্লাহর নুরের আলোতে অন্তরের ঘর আলোকিত রাখতে পার, তাহলে বার্ধক্য ছুঁইতে পারবে না তোমাকে। চিরন্তন যৌবনে উদ্ভাসিত হবে তোমার সমগ্র জীবন, বলা হয়েছে। ‘যারা মোমেন ও সৎকর্মপরায়ণ; তাদের জন্য তো আছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।’ (সুরা তীন, আয়াত-৬)।

লেকে গর বা’শদ তবীবাশ নূরে হক

নীস্ত আয পীরীয় ও তব নোকসান ও দক

তবে যদি আল্লাহর নূর হয় তোমার চিকিৎসক

নাই কোনো রোগশোক জরা-বার্ধ্যকের ভয়ড়র। ৯৭৪

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-৮৪৫-৯৭৪)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে- ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়াপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত