ঢাকা ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুফিবাদে মুসলিম আইনের উৎস

দিলরুবা খানম (অব. শিক্ষিকা), লেখক ও গবেষক
সুফিবাদে মুসলিম আইনের উৎস

ইসলাম শুধু একটি ধর্ম বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ নয়, এর পরিধি ব্যাপক। এটা মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, আর শরীয়ত, তরীকত, মারেফত, হাকীকত হচ্ছে এই ইসলামী জীবন বিধানেরই এক একটি বিশিষ্ট পদ্ধতি।

Bertram Thomas বলেন, ‘Shariah or Islamic law was the code of sanctions collected from the Quran To disobey Sharia was to infringe religious ordinance, (The Arabs, ১৯৪০) Custom বা প্রথা মানবমনের অজ্ঞাতসারে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে যথা আরবের প্রাচীন আইনগুলো কিন্তু মহানবী (দ.) সময় থেকে কোরআন নির্দেশিত পথে আইনের বিকাশ শুরু হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন উৎস এর মাধ্যমে ইসলামী আইন কার্যকারী করা হলেও তা যুগোপযোগী করে প্রকাশিত করা হয় ইমাম ও সুফিদের মাধ্যমে।

আমরা দেখতে পাই প্রাক ইসলামী যুগে লিখিত কোনো আইন ছিল না। যেগুলো ছিল তা অনিশ্চিত, হযরত নবী করিম (দ.) ৬১০ খ্রিঃ নবুয়ত প্রাপ্তির পর তিনি নিজে আল্লাহর ইচ্ছায় মুসলিম আইনগুলো নির্দিষ্ট করে দেন। দেখা যায় যে, চারটি পর্যায়ে আইনগুলো প্রণীত হয়েছিল, The history of Muhammadan law and Jurisprudence broadly divisible into four periods. যেমন-

Frist Period: হযরতের (দ.) ৬২২-৬৩২ খ্রিঃ হিজরতের থেকে হযরতের ওফাত পর্যন্ত সময়টা ছিল মুসলিম আইনের প্রথম যুগ। ইহার নাম ছিল ‘বিধান প্রবর্তনের যুগ’ (Legistative period) এই সময় বিভিন্ন আইন সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান দেয়া হয়। পূর্বে কোনো লিখিত সংবিধান ছিল না, মহানবী (দ.) বিভিন্ন জাতির মাধ্যমে সাম্য, ঐক্য ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য মদিনা সনদের মাধ্যমে একটি লিখিত সংবিধান প্রদান করেন। মহানবী (দ.) আল্লাহর দিদার লাভ করেন ৬১৯ খ্রিঃ যাকে মেরাজ বলা হয়। এটা ছিল সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। শবে মেরাজ থেকে এসে তিনি কোরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে সমগ্র জাতির জন্য দিক নিদের্শনা প্রদান করেন, শিখন এবং শেখান পদ্ধতি দিয়ে বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে আইনের উৎস ও নিয়মগুলো প্রবর্তন করেন। যার দ্বারা মানুষ নির্মম, বর্বরতা, অজ্ঞতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা পেয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হয়। নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য আত্মচেতনার জন্য সুফীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা প্রদান করেন।

Second period: হয়রত নবী করিম (দ.) ওফাতের পর থেকে সাহাবী যারা নবীর সংস্পর্শে এসেছিল তাদের থেকে তাবেঈনদের (যারা নবীর সংস্পর্শে আসে নাই) পর্যন্ত ছিল ২য় যুগ। এই সময় ছিল সাহাবী এবং তাবেঈনদের যুগ, তারা কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে ইসলামের বিভিন্ন আইন প্রচার করেন, যেগুলো কোরআন ও হাদীসের মধ্যে স্পষ্ট নহে, সেগুলো তারা নিজেদের বুদ্ধি মত্তার মাধ্যমে প্রয়োগ করেন। এমনকি যুগোপযোগী করে কার্যকরী করার ব্যবস্থা করেন।

Third period: ওমাইয়াদের পর থেকে আব্বাসীয় অর্থাৎ হিঃ ২য় শতাব্দীর শেষ থেকে ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত (৬৬১ খ্রিঃ-১২৫৮ খ্রিঃ) সময়টা ৩য় যুগ। এই সময় ৪টি মাযহাব যেমন- হানাফী মাযহাব শাফী মাযহাব, মালেকী মাযহাব হাম্বলী মাযহাব ও সিহাহ্ সিত্তাহ প্রবর্তন হয়েছিল। এই সময় আইনের উৎসগুলো বিস্তারিতভাবে মানুষের মাঝে প্রচার করা হয়। অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় মানুষের মাঝে প্রকাশ করা হয়।

Fourth period: হিজরী ৩য় শতাব্দী অর্থাৎ চার ইমামের পর থেকে ৪র্থ পর্যায় শুরু হয়। যতদিন পর্যন্ত ইসলাম থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই আইন বলবৎ থাকবে। এই আইন এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সঠিক পথে পরিচারিত করা ও আল্লাহ রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। প্রতিটি মুসলমানদের কর্তব্য এই আইন অনুসরণ করা, বাস্তব জীবনকে উপলব্ধি করতে হলে আত্মচেতনাবোধে জাগিয়ে তোলার জন্য আইনের প্রয়োজন।

এই আইনের উৎসগুলো আমাদের জানতে হবে বুঝতে হবে পুঙ্খানুরূপে উপলব্ধি করতে হবে, নিম্ন, উঁচুশ্রেণী শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমস্ত জাতিকে এই আইন সম্পর্কে জানাতে হবে। এই আইনের মাধ্যমে জীবনকে অতিবাহিত করতে হবে। তাহলে আমাদের জীবনে নেমে আসবে সুখ-শান্তি ও শৃঙ্খলা। এই আইন বিভিন্ন ইমাম ও সুফিদের মাধ্যমে কার্যকরী হচ্ছে, ইহা বর্তমানে, ভবিষ্যৎ এমনকি কেয়ামত পর্য়ন্ত কার্যকরী হবে।

Source of Muslim law: মুসলিম আইন বিজ্ঞানের নাম ফিকাহ্। এই বিজ্ঞানের প্রধান প্রধান উৎস হচ্ছে মহাগ্রন্থ কোরআন ও হাদীস। কিন্তু মুসলিম জাতির রাজ্য বিস্তৃতিতে যে ক্রমবর্ধিষ্ণু সমস্যার উদ্ভব হয় তার সরাসরি সমাধান কোরআন হাদীসে পাওয়া না যাওয়ায় মুসলিম ফকিহরা বুদ্ধির সহায়তায় নতুন নতুন জীবন সমস্যার সমাধানে কোরআন হাদিসের বুদ্ধিবৃত্তিমূলক প্রয়োগ ছাড়াও ইজমা কিয়াসের ইজতেহাদ এর সাহায্যে মুসলিম কানুনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এর বিবর্তনের পথ উন্মুক্ত করে যান। যেমন-

আইনের প্রথম উৎস আল-কোরআন : প্রথম উৎস হিসেবে কোরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য সঠিক পথপ্রদর্শক একটি গাইড, আরবী ‘কুরআ’ থেকে উদ্ভুত কোরআনকে ‘আল-কুরআন’ ‘আল-হিকমত’ আল হুকুম ফোরকান আল হক আলনূর তানজির বলা হয়েছে। এই মহাগ্রন্থ ৪০ বছর বয়সে মহানবী (দ.) এর কাছে জিব্রাইল (আ.) স্বর্গীয়দূত ফেরেস্তার মাধ্যমে প্রথম সূরা-আয়াত ৬১০ খ্রিঃষ্টাব্দে পারা খণ্ডে হেরা পর্বতে ২৭ রমজান নাযিল হয়। হইা ২৩ বছরে ৩০ পারা খণ্ডে খণ্ডে অবতীর্ণ হয়ে সমাপ্ত হয় ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ইহাতে ১১৪টি সূরা, ২টি মঞ্জিল, ২২৩টি রুকু সর্বমোট ৬৬৬৬ টি আয়াতের সমষ্টি। কোরআনের সুরাগুলোকে দু’ ভাগে ভাগ করা হয়। মক্কী সূরা (মক্কায় অবতীর্ণ) মদিনা সূরা (মদিনায় অবতীর্ণ) প্রথম সূরা ‘ইকরা’ শেষ সূরা ‘নাসর’ বড় সূরা বাকারা, ছোট সূরা আসর। এই কোরআনের আয়াতগুলো আল্লাহর আরশে লওহে মাহফুজে রক্ষিত ছিল। ওখান থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় মহানবী (দঃ) উপর অবতীর্ণ হয়। কোরআনের ভাষা আরবী, আরবদের ভাষাও আরবী মহানবীর ভাষাও আরবী। তাই আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়।

হযরত নবী করিম (দ.)-এর উপর অহি বিভিন্নভাবে নাযিল হয় যেমন- (১) স্বপ্নযোগে, (২) শব্দের মাধ্যমে (৩) মনুষ্যরূপ ধারণ পূর্বক, (৪) ঘণ্টাধ্বনির ন্যায় শ্রবনের মাধ্যমে। অহি আবার দু’রকম।

(ক) অহিয়ে মকতু এবং অহিয়ে মাকফি, কোরআনের ভাষা হচ্ছে আরবী, ইহার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ লেখক হচ্ছে ‘জায়েদ-বিন-সাবিত। জ্ঞানের আধার নামে অভিহিত কোরআন শব্দটির উৎস হচ্ছে কাবা অথবা পাঠাগার।

কোরআন হলো আল্লাহতালার সৃষ্ট সংবিধান, ইহার বিধিনিষেধ বিনা বাধায় ইসলামী আইনের অন্যতম প্রধান উৎসরূপে স্বীকৃত হয়েছে। আয়াতসমূহের মধ্যে যেগুলোকে মুসলিম আইনের উৎস বলে চিহ্নিত করা যায় সেগুলোর প্রকৃতি নিম্নরূপ (১) সমতার ভিত্তিতে উত্তরাধিকারের নীতি নির্ধারণ এবং নারী জাতির মর্যাদার উন্নয়ন প্রভৃতি সামাজিক সংস্কারের জন্য কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল (২) তৎকালে উত্থিত প্রশ্নাবলীর সমাধানের জন্য কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। (৩) শান্তি শৃঙ্খলার জন্য শাস্তির নীতিমূলক কিছু আয়াত। (৪) অক্ষম ব্যক্তি ও নাবালকদের হেফাজতের জন্য কিছু আয়াত। অর্থাৎ মুসলিম জাতির ধর্মীয় রাজনৈতিক সামাজিক, নৈতিক আধ্যাত্মিক বিষয় সম্বন্ধে কর্ম সমাধান দিয়ে মানুষকে পাপাচার থেকে পরিশুদ্ধ করে জীবনের লক্ষ্যার্জনে সহায়তা করার জন্য কোরআনে যে পথ নির্দেশ রয়েছে তাই-ই এই গ্রন্থের মহৎ অবদান। কোরআনের শুরুতে আছে- ‘ইহা ঐ গ্রন্থ যাহার মধ্যে সন্দেহ নেই এবং ইহা ধর্মভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক।’ ইসলামের মূলনীতি ও কানুন সংক্রান্ত যে কোন আলোচনায় আল কোরআন ইসলামের সম্পূর্ণ কাঠামো হিসাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, চূড়ান্ত দলিল বলে স্বীকৃত। ১৪০০ বছর আগে কোরআন নাযিল হয়েছিল সমগ্র জাতির জন্য দিকনিদের্শনা। আল্লাহ নিজে বলেছে’ আমি গুপ্ত ছিলাম, আমি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য কোরআন নাযিল করেছি, কোরআন হচ্ছে মানুষের সর্বাঙ্গীণ জীবন ব্যবস্থা। একটা মানুষের জাতির, সমাজের জন্য যা কিছু দরকার সব এই কোরআনে রয়েছে। বর্তমানে কোরআনের আয়াতগুলো সুন্দরভাবে বাংলাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আরও বিভিন্ন ভাষার তর্জুমা ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে মানুষ সহজে উপলব্ধি করে সঠিক পথে অগ্রসর হয়। ইসলামকে জানতে হলে কোরআনের মাধ্যমে জানতে হবে। কোরআনের আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো সুফিদের মাধ্যমে বেশি প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। কোরআনকে জানতে হলে বুঝতে হলে ইমাম ও সুফিদের অনুসরণ করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহর কাছে পৌঁছতে হলে কোরআন শিক্ষা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ। আল্লাহ কোরআনে বলেছে- ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদের স্মরণ করব’।

আইনের ২য় উৎস আল-হাদিস : The hadith is also one of the elementary sources of the Muslim law it stands next to the holy Quran, in Importance.

ইসলামী কানুনের দ্বিতীয় উৎস ‘হাদীস শরীফ’ বা সুন্নাহ হল মহানবীর জীবনী (বাণী ও কাজের লিখিত রূপ) হাদিস তিন প্রকার (ক) কাউল বা রাসূলের ভাষ্য (খ) ফিল বা রাসূলের কার্যকলাপ (গ) সকুত বা নীরবে অনুমোদন। হাদিস শব্দটির মূল উৎস বর্ণনা। হাদিসকে কোরআনের ভাষ্য বলা হয়ে থাকে। যা সব বিচারক এবং মুসলমানরা স্বীকার করেছেন। কারণ কোরআন শরীফে ইসলামী কানুনও জীবন ব্যবস্থার মূলনীতি এবং আয়াতগুলোর ইঙ্গিত থাকলেও এগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা হাদিস ছাড়া জানা অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কোরআনে নিদের্শ আছে। (Aqimu-1-salata, Atu-zakata: (৩৩:২১) নামাজ পড় জাকাত দাও) কিন্তু কখন কীভাবে কত ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে, কীভাবে জাকাত দিতে হবে তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে হাদিস শরীফে। অর্থাৎ কোরআনে মূলনীতি হিসাবে যা বর্ণিত হয়েছে হাদিসে তারই ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ পদ্ধতি বিস্তÍৃত হয়েছে। তাই হাদিস হল মুসলিম কানুনের নির্ভরস্থল এবং কোরআনের পরিপূরক। কোরআন সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয় হাদিসে। কোরআনের আয়াতগুলো সর্বসাধরনের মধ্যে সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয় হাদিসের মাধ্যমে। নবী করিম (দ.) বলেছেন’ সমগ্র জাতির জন্য দুটি জিনিস রেখে গিয়েছি, যদি সবাই এই দুটো জিনিস অনুসরণ করেন তাহলে সবাই সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারবে। তাহলো আল্লাহর কোরআন ও রাসুলের হাদিস। আবু হোরায়রা, বিবি আয়েশা, ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ, ইবনে ওমর এই চারজন ছিল অনেকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রথম হাদিস সংকলনকারী। তারা লিখে ও মুখস্ত করে রাখত। পরবর্তী সময়ে ৫টি Stage এর মাধ্যমে হাদিস সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু সিহাহ্ সিত্তাহ্ এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহন করেছিল। কিন্তু রাওয়ায়েত ও রাবিত এর মাধ্যমে হাদিস সংকলন করেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে যাচাই বাছাই করে শুদ্ধ হাদিসগুলো বিভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ করেন, ৬জন হাদিসবেত্তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইমাম বোখারী, ইমাম মুসলিম। জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য অবশ্যই হাদিস গ্রহণ করতে হবে।

ইজমা : কোরআন ও হাদিস এরপর ইসলামের আইনে তৃতীয় উৎস হচ্ছে ইজমা, আরবী জমি শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ ‘একমত হওয়া’।

Ijma means consensus of opinion of the Mujtahids or an agreement of the Muslim jurists of a particular age on a Question of law. স্যার আবদুর রহীমের মতে কোন বিশেষ যুগে কোন বিশেষ প্রশ্নে মুসলিম আইনজ্ঞদের ঐক্যমতকে আইনের পরিভাষার ইজমা বলে। ইহার দু’টি তৎপর্য রয়েছে। যেমন- কোন অমীমাংসিত বিষয়ের মীমাংসা করা ও কোন একটা স্বীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছা এবং কোন একটা মতামতের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা যায়। যার প্রেক্ষিতে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা হয়। মহানবী জীবিত অবস্থায় কোন সমস্যা অহির মাধ্যমে তিনি সমাধান করতেন কিন্তু তাহার ওফাতের পর অহি বন্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে মুসলিম রাষ্ট্রের বিস্তৃতির ফলে নবোদ্ভূত অনেক সমস্যা দেখা যায় যা কোরআন হাদিস নিয়ে সমাধা হয় না ফলে মুসলিম সমাজ কোরআন হাদিসের শিক্ষার ভিত্তিতে স্বাধীন চিন্তাই ইজমার প্রয়োজন অনুভব করে। যা জ্ঞানী লোকেরা একত্রিত হয়ে সমস্যা সমাধান করেন। ইজমা তিনটি উপায়ে নির্ধারিত হইয়া থাকে। যেমন- কাউল বা কথায়, ফেল বা কার্যে, সকুত বা নীরবতা, ইজমা আবার দু’ শ্রেণিতে বিভক্ত, যেমন- (র) ইজমায়ে আজিমা (৫/৬ জন মুজতাহিদ এর একমত) (রর) ইজমায়ে রুখসাহ্ (সবাই গ্রহণ করে না) ইজমাকে Obey করাটা সবাইর জন্য ফরজ। যারা অমান্য করে তারা কাফের। যে সমস্যা যে দেশে আসে সেই দেশের Jurist সমাধা করবেন।

ইজমার ঐক্যমত সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন-

(i) To-day, we have completed your religion. (Quran)

(ii) Do not be like those who to separated and divided offer they have received the clear proof.(Quran)

(iii) bey God, obey the prophet and those who have authority amongst you. (Quran)

(iv) My followers would never agree upon wrongs.(Quran)

(v) It is incumbent or you to follow the most numerous bodz. (Hadith)

(vi) Whoever separates himself from the main bodz will go to hell. (Hadith)

ইজমাকে মুসলিম আইনের উৎসের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চার ইমামের মতে- Ijma is not confined to the jurist any time or any country.

কিয়াস : কিয়াস মুসলিম শরিয়তী আইনের চতুর্থ উৎস। যে প্রশ্নে কোরান হাদিস নিশ্চুপ এবং ইজমা ‘মূক’ সেই প্রশ্নের সমাধানকল্পে সব সুন্নী মাযহাব যে উৎসের আশ্রয় গ্রহণ করেন তাকে কিয়াস বলা হয়। অর্থাৎ চিন্তার মাধ্যমে নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে ‘কিয়াস’ বলা হয়। iyas is A process of deduction by which the law of a text is applied to Cases which, though not Covered by the language are governed by the reason to the text, কিয়াস অর্থ পরিমাণ করা বা তুলনা করা। কিয়াসের প্রবক্তা ইমাম আবু হানিফা, তার প্রচেষ্টায় ইহা উৎসরূপে গৃহীত হয়। অবশ্য তিনি কোরআন ও হাদিসের উপর নির্ভর ছিলেন। তাঁর সহযোগিদের ‘আহলে কিয়াস’ বলা হয়। মহানবী (দ.) তিরোধানের পর নুতন নুতন সমস্যা দেখা দিলে যেমন পূর্বে খেজুর আঙ্গুর এগুলো দিয়ে মদ তৈরি হয় পরবর্তী সময়ে অন্য সামগ্রী দিয়েও মদ তৈরি হয়, এ রকম নুতন সমস্যা আসলে কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া না গেলে ইজমার মত কিয়াসের সাহায্যে মুজতাহিদগণ কোরআন হাদিস ও ইজমার উপর ভিত্তি করে যুক্তি দ্বারা সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতেন। কাজেই ইসলাম প্রগতির জন্য কিয়াস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা কিয়াস করবেন অর্থাৎ মুজতাহিদদের অবশ্য হাদীস, কোরআন ইজমা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে হবে। নবী করিম (দ.) এর ওফাতের পর কিয়াসের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

ইজতেহাদ : ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ৫ম উৎস হলো ইজতেহাদ। ইজতেহাদ শব্দটি জাহদুন’ শব্দ হতে উদ্ভূত, জাহদুন শব্দের অর্থ হল গবেষণা করা। ইসলামি পরিভাষায় শরিয়তের কোন নির্দেশ সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে সর্বাঙ্গীন চেষ্টা ও সমাধানের নাম ইজতেহাদ। আল্লামা ইকবাল ইজতেহাদকে principle of Movement in Islam হিসাবে বর্ণনা করেন। সাধারণ লোকের চিন্তাধারায় ইজতেহাদ হয় না। লেখক লেইন বলেন, A lawyers exactly in the faculty of mind to ut-most for the purples of family an opinion in case of law respecting a careful difficult point laws.

পবিত্র কোরআন ও সুন্নার ভিত্তিতে কিয়াস প্রয়োগ করে ইজতেহাদ করা হয়ে থাকে, ইসলামের প্রথম যুগে কিয়াস এবং ইজতেহাদ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যিনি ইজতেহাদ করেন তাঁকে মুজতাহিদ বলা হয়। তাকে অবশ্য হাদিস কোরান ও আইন সম্বন্ধে যাবতীয় জ্ঞান থাকতে হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যুক্তি প্রমাণ ব্যতিরেকে অপরের মত মেনে নেয় তাকে মুকাল্লিদ বলা হয়। অনেকের ধারণা বর্তমানে ইজতেহাদের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে তা ঠিক নয়, ইসলামি যাবতীয় জ্ঞান-গুণ থাকতে ইজতেহাদ করা অবৈধ নয়। পবিত্র কোরান ও হাদিসে স্বাধীন গবেষণার নিদের্শ রয়েছে। গবেষণা ছাড়া সঠিকতত্ত্ব বেরিয়ে আসে না। প্রত্যেক নর-নারীর শিক্ষার গ্রহন করে গবেষণার মাধ্যমে সমগ্র জাতির আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বর্তমান ও ভবিষ্যতের নতুন নতুন তথ্যের জন্য গবেষণা দরকার। বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য গবেষণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

ইসতিহ্সান : পরবর্তী শতাব্দীতে কোনো বিধান কিয়াসের চাহিদা হতে পৃথক হলে তাকে ইসতিহ্সান বলা হতো। ইসতিহ্সান অর্থ বিচারবিবেচনায় যা মঙ্গলজনক। (অর্থাৎ জনসাধারণের জন্য সহজ হয়) কিয়াসের যদি সমস্যা সমাধান কঠিন মনে হয় তখন জন সাধারণের সাহায্যের জন্য ইসতিহ্সান ব্যবহার করা হয়। ইমাম আবু হানিফা ইহার প্রবক্তা। ইমাম শাফী এর বিরোধিতা করেন, যা আইনের একটি নিরপেক্ষ উৎস। বিভিন্ন জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্য এই উৎসের প্রয়োজন রয়েছে।

ইসতিসলাহ্ : ইসতিহ্সানের থেকে সহজ হচ্ছে ইসতিসলাহ্। ইসতিসলাহ্ অর্থ জনকল্যাণ। ইমাম মালেক এর প্রবক্তা। এটা জনসাধারণের কল্যাণের ওপর সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সহজ পরিকল্পনা ইসতিহ্সানকে যারা বিরোধিতা করে তারা ইসতিসলাহ্কে বেশি গ্রহন করেন নাই, ইমাম গাজ্জালী এটাকে ‘আইন প্রয়োগের সবচেয়ে সহজতর পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেন।’

ইসতিদলাল : যেসব পুরোনো ধর্ম আইনগুলো কোরআনে বাতিল ও হাদিসে নিষেধ ঘোষণা করা হয় নাই তার উপর নির্ভর করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা ইসতিদলাল, ইহার অর্থ যুক্তি নির্ণীত সিদ্ধান্ত বা দলিল, এটা কোরআন, হাদিস ইজমা কিয়াসের উপর নির্ভর করে না। এই আইন মেনে চলা ফরজ।

Many decisions of law are based on Usage and customs so much so that it has been taken as a principle of laws. (MT) কিয়াসের বাইরে সকল প্রকার অনুসিন্ধান্ত কে ইসতিদলাল বলা যায়, কাজী ওদুদ বলেন, যে ইসতিদলালের মধ্যে ইসতিহসান এবং ইসতিসলাহ্ বর্তমান।

ইসতিসহাব : ইহা যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শরিয়তের বিধান নির্ধারণের একটি প্রক্রিয়া। ইহার অর্থ যোগসূত্রের সন্ধান। ইমাম শাফি মাযহাবে এটা বিশেষভাবে এবং ইমাম হানাফী মাযহাবে সীমিতভাবে স্বীকৃত। চুক্তি দিয়ে যুক্তি হয় না, যুক্তি দিয়ে চুক্তি হয়। যুক্তির মাধ্যমে যে কোন সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়। আইন হল একটি সমাজ সম্প্রদায় সর্বোপরি একটি জাতি পরিচালনা ও অগ্রগতির স্বচ্ছ দর্শন স্বরূপ। সমাজ ও জাতির প্রয়োজনে মানব রচিত আইন উদ্ভূত হয়। আইনই সমাজকে গঠন ও পরিচালিত করে সাম্য ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

এটা সর্বজন বিদিত যে আরব ভূমিতেই ইসলাম আইনের জন্ম এবং আরব ফকিহ্রা সুফিরা বিভিন্ন দেশে এর বিকাশ সাধন করেন। যেমন গাউছ মাইজভান্ডারী হযরত আহমদুল্লাহ্ (কঃ) এবং তাহার কাছে ফয়েজপ্রাপ্ত ও বেলায়েত প্রাপ্ত সুফীরা সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় আইনের উৎস প্রকাশিত করেছেন, যার মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি লাভ করে সঠিক পথে পরিচালিত হয়। এই আইনের উৎসগুলো মহানবী (সা.) ইসলামী মূল আদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অগ্রসর হয়েছে। কোরআন মজীদ দিয়েছে প্রস্তাবনা ও আদর্শ হাদিস দিয়েছে ব্যাখ্যা সেই প্রস্তাবনা ও ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে বিভিন্ন আইনের উৎস যা সর্বাবস্থায় উপযোগী ইসলামী আইনের নীতিমালা। প্রত্যেক নর-নারীর দরকার এই আইনের মাধ্যমে জীবনকে অতিবাহিত করা। সবাইকে আল্লাহ সৎ জীবনযাপন করার তৌফিক দান করুন।

সহায়ক গন্ত্রপঞ্জিকা :

1. Encyclopedia of Islam By Vol. I.

2. The Principles of Muhammadan

Jurisprudence By Abdur Rahim M.A.

3. The Religion of Islam

By Muhammad Ali.

4. The life of Muhammad

By W. Muior.

5. ইসলামের ইতিহাস

By জাকারিয়া খান।

6. ইসলামী আইনতত্ত্বের ভাষ্য

By গাজী সামসুর রহমান।

7. মুসলিম দর্শনের ভূমিকা

By অধ্যাপক রশিদুল আলম।

8. The Arabs By Bertram Thomas

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত