এক তোতা আয়নায় নিজের ছবির প্রতিফলন দেখে মনে করল, তার মতো আরেক তোতা এগিয়ে এসেছে, কথা বলতে চায়। তখন আয়নার পেছনে লুকিয়ে একজন প্রশিক্ষক কথা বলল গোটা গোটা বুলিতে। তোতা ভাবল, সামনে উপস্থিত তোতা তার সাথে কথা বলছে। তোতা তখন বন্ধুর সাথে কথা বলতে লাগল। তোতা যদি জানত যে, কোনো মানুষ তার সাথে কথা বলছে, তাহলে সে কথা বলত না। কারণ, মানুষ তার সমগোত্রীয় কেউ নয়। অতীতে তোতার মুখে বুলি ফোটানোর এটিই ছিল কায়দা। আয়নার পেছনে দক্ষ প্রশিক্ষক লুকিয়ে গোটা গোটা উচ্চারণে কথা বলত। আয়নার ছবিতে সমজাতীয় তোতা তার সাথে কথা বলছে মনে করে, সে কথা রপ্ত করার জন্য বারবার আওড়াত। এভাবেই তোতার মুখে বুলি ফোটানো হত। কারণ ছিল, তোতা তার সমজাতের কেউ না হলে তার কাছ থেকে বুলি শেখে না।
মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, সাধারণ মানুষের ক্ষমতা ও যোগ্যতা নেই যে, অহির উৎস মহান রাব্বুল আলামীনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে, কথা বলবে। এ কারণে ইনসানে কামিল, পূর্ণ মানবীয় যোগ্যতার অধিকারী মহামানবগণ মধ্যস্থ হয়ে মানুষকে আসমানী জ্ঞানের সবক দিয়েছেন। তারাও ছিলেন নবী-রাসুল (আ.) এবং মানুষের সমজাতের। মানব সম্প্রদায় থেকেই তাদের নির্বাচিত করেন আল্লাহতায়ালা। যাতে মানুষ তাদের আপনজন ভেবে তাদের কাছ থেকে দ্বীনের তালিম নেয়। তাদের উপমা তোতার সম্মুখের আয়না। আয়নার পেছনে আসল তালিমদাতা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। আল্লাহতায়ালাই নবী-রাসুলগণের সাথে অদৃশ্যে থেকে কথা বলেন। কোরআন মাজিদের ভাষায়- (অনুবাদ) ‘তিনি (রাসুল সা.) মনগড়া কোনো কথা বলেন না। বরং এ তো (কোরআন) অহি, যা তার কাছে প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা আন নাজম : ৩,৪)।
আফসোস হলো, বাহ্যদর্শী লোকেরা নবী-রাসুলগণের উচ্চারিত ভাষার বাইরের রূপটাই দেখে। ভাষার ভেতরের যে প্রাণসত্তা, তা বুঝতে পারে না। এরা তোতা পাখির মতো নবী-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের কথার বুলি আওড়ায়। এসব বুলির চর্চা করে দুনিয়া কামাই ও উপার্জনের ব্যবস্থা করে। হায়াতুল হায়ওয়ান কিতাবে বর্ণিত আছে, বাদশাহ হারুনুর রশীদের একটি তোতা ছিল, সেই তোতা সুরা ইয়াসীন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ পাঠ করে শোনাত। অনেক জ্ঞানী আছেন, তারা আল্লাহর কালামের বাণী তোতা পাখির মতো মুখে মুখে আওড়ান। অথচ তার অন্তর্নিহিত হাকিকতের খবর তাদের নেই।
মওলানা রুমি (রহ.) আরো বলেন, আল্লাহর অলিদের সামনে গিয়ে অনেক মানুষ নিজের ছবিই দেখে। তার বাহ্যিক অবয়ব দেখে বিচার বিশ্লেষণ করে। তোতা যেমন আয়নায় প্রতিফলিত তার নিজের ছবি দেখে, আয়নার পশ্চাতে লুকায়িত মানুষটিকে দেখে না, যাহেরী দৃষ্টির এসব জ্ঞানীও অহিলব্ধ জ্ঞানের মাহাত্ম্য বুঝে না, বুঝার চেষ্টা করে না। আল্লাহর কালাম তোতার মতো তেলাওয়াত করে, মুখস্থ করে কিংবা বাহ্যিক অর্থ পাঠ করে নিজেকে অনেক বড় জ্ঞানী বলে জাহির করে। একইভাবে কিছু লোক পাখিদের বুলি শেখে। মুখে আওড়ায়। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বাহবা কুড়ায়। কিন্তু পাখির মনের ভাব তারা বুঝতে পারে না। সৌভাগ্যবান বাদশাহ নবী সুলায়মান (আ.) পাখিদের বুলির মর্ম বুঝতেন। মানব সমাজে কোরআন হাদিসের জ্ঞানের প্রচারক, আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথার প্রবক্তা প্রচুর আছে। এরা পূর্বের মনীষীদের বিভিন্ন উক্তি শিখে, অলি বুযুর্গদের মুখের বচন রপ্ত করে তা নিয়ে বাজার সরগরম রাখে আর দুনিয়া কামাইর ব্যবস্থা করে।
হারফে দারবীশা’ন বাসী আ’মূখতান্দ
মিম্বারো মাহফেল বেদা’ন আফরূখতান্দ
দরবেশদের বুলি অনেকেই শিখে মুখে মুখে
মিম্বর ও মজলিসে আলো ছড়ায় বুলি আওড়িয়ে।
এই শ্রেণির লোকদের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে সম্পর্কে মওলানা বলেন,
য়া’ বজুয আ’ন হারফেশা’ন রূযী নাবুদ
য়া’ দার আখের রাহমাত আ’মাদ রাহ নামূদ
হয়ত এসব বুলি ছাড়া তাদের কপালে কিছু নাই লেখা
নয়ত শেষে রহমত নেমে দেখাবে তাদের পথের দিশা।
এই লোকদের সামনে দুটি অবস্থার বিকল্প নেই। হয়তো এভাবে বুলি আওড়ানোর মধ্যেই তাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। ভালো কিছু নসিবে জুটবে না। অথবা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমত এসে তাদের সহায় হবে, সঠিক পথের দিশা দিবে। তবে বড় আফসোস হয়, যারা ধর্মের নানা কথার ফুলঝুরিতে মজলিস মাহফিল গোলজার করেন। দরবার ও খানকাহয় ভক্ত-মুরিদের জমকালো আসর জমান। অথচ নিজেদের চর্চিত বুলির ভেতরে যে মর্মবাণী তার খবর জানার আগ্রহ ও উপায় কোনটাই তাদের নাই। মওলানা একটি ছোট্ট গল্পের অবতারণা করে বুঝিয়ে বলেন যে, অনেকেই দাবি করেন তারা বড় জ্ঞানী, তাদের আছে দিব্যদৃষ্টি। কিন্তু মারেফতের সূর্য তাদের অন্তর্জগতকে তাপিত করেনি। ফলে তাদের অন্তরের অন্দর মহলে অন্ধকার হাহাকার করে।
এক বুযুর্গ চিল্লায় বসেছিলেন। চিল্লা শব্দের উৎপত্তি ফারসি চেহেল বা চেল থেকে। মানে চল্লিশ। একটানা চল্লিশ দিন সংসারের সংশ্রব ত্যাগ করে দুনিয়ার আকর্ষণ লোভমোহ থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন করার সাধনাকে বলা হয় চিল্লা। মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব আনার প্রস্তুতি হিসেবে ৩০ দিন রোজা রাখেন। একমাস শেষ হলে তাকে অতিরিক্ত আরো ১০ দিন রোজা পালনের হুকুম দেয়া হয়। তারপরই তাকে কূহে তূরে তাওরাত কিতাব দেয়া হয়। কোরআন মাজিদে বর্ণিত এই ঘটনাকে চিল্লার পক্ষে দলিল দেন সুফিসাধকগণ।
যাহোক, চিল্লার মেয়াদে জনৈক দরবেশ স্বপ্নে দেখেন রাস্তার ধারে একটি মাদী কুকুর। কুকুরীর পেটের ভেতর বাচ্চারা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ঘুম ভেঙে গেলে বুযুর্গ চিন্তায় পড়ে যান স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে। মায়ের পেটে কুকুরছানা ঘেউ ঘেউ করে, জগতে কী কেউ এমন ঘটনা দেখেছে? অথচ এই স্বপ্ন দেখেছেন চিল্লা চলাকালীন মেয়াদে। কাজেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা পাওয়ার আশা নেই। তিনি ফরিয়াদ জানালেন, প্রভুহে! আমার মনের পেরেশানী দূর কর, এই রহস্যের কূলকিনারা করে দাও।
আ’মাদাশ আওয়া’জে হাতেফ দার যামান
কা’ন মেসালী দা’ন যে লা’ফে জা’হেলা’ন
তখনই একজন আওয়াজ দিলেন অদৃশ্য হতে
এই স্বপ্নকে জান মূর্খণ্ডজাহেলদের উপমারূপে।
এই স্বপ্নের মাধ্যমে তোমার সামনে মূর্খ জাহিলদের পরিচয় ব্যক্ত করা হয়েছে। মূর্খ জাহিলরা বড় বড় আস্ফালন আর গলাবাজি করে। অথচ তারা এখনো আমিত্বের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। কিংবা মনুষ্যসুলভ পর্দায় আচ্ছাদিত। অন্তরালে বিরাজিত খবর জানার যোগ্যতা অর্জন করেনি। অন্ধ অনুকরণ করে অন্যের মুখের বুলি আওড়ায়। তাদের অবস্থা মায়ের পেটে কুকুরছানার ঘেউ ঘেউ চিৎকার। এই চিৎকার তো অনর্থক। এমন আওয়াজ দিয়ে কোনো শিকার ধরার সুযোগ নেই। গৃহস্থের বাড়ি পাহারার কাজও হয় না তাতে। এরা অনভিজ্ঞ, অপরিপক্ব, তাই গলাবাজি করে, জ্ঞানের বাহাদুরি আর বুজুর্গী দেখায়। এরা লোভী, নেতৃত্ব চায়।
আয হারীচী ওয়ায হাওয়ায়ে সারওয়ারি
দর নাযার কুন্দ ও বে লাফিদান জরী।
লোভের চোটে ও নেতৃত্ব পাওয়ার আশায়
দৃষ্টি সংকীর্ণ এরা আস্ফালন করে স্পর্ধা দেখায়।
এরা ক্রেতা খুঁজে বেড়ায়। দাওয়াত ভাগানো, মুরিদ জোগাড় করাই উদ্দেশ্য। এদের দৃষ্টি সংকীর্ণ, মনের উদারতা নেই। সরগরম বাজার পাওয়াই তাদের লক্ষ্য। হাকিকতের চাঁদ না দেখেই এরা চাঁদের শতরূপ বর্ণনা করে। মানুষ জুটায়। লোকদের গোমরাহ করে। মুশতারি বা ক্রেতার প্রসঙ্গ আসাতে মওলানার চিন্তা চলে গেল ঊর্ধ্বলোকে। তিনি বলেন, এরা ক্রেতা খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু একজন ছাড়া অন্য ক্রেতার সাথে কেনাবেচা করলে তো ঠকতে হবে। জীবন বরবাদ যাবে। কারণ আমাদের ক্রেতা তো একজন।
মুশতারিয়্যে মা’স্ত আল্লাহুশ তারা’
আয গামে হার মুশতারি হীন বারতার বিয়া’
আমাদের ক্রেতা আল্লাহই কিনেছেন আছে কোরআনে
অন্য ক্রেতার ধান্ধা ছেড়ে যাও এগিয়ে ঊর্ধ্বপানে।
মুসলমানের সমস্ত কাজ তো হবে আল্লাহর ওয়াস্তে। মুসলমানের জীবন ও সম্পদ তো আল্লাহই ক্রয় করে নিয়েছেন। মওলানা রুমি এখানে কোরআন মাজিদের নিম্নোক্ত আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মোমেনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য জান্নাত আছে। তারা আল্লাহর রাস্তায় লাড়াই করে। নিধন করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইনজিল ও কোরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করেছ তার জন্য আনন্দিত হও এবং এটিই তো মহাসাফল্য।‘ (সুরা আহযাব : ১১১)।
মওলানা রুমি বলেন, এই অবস্থায় উপনীত হওয়ার জন্য তোমাকে প্রথমে মনস্থির করতে হবে। তোমার ভালোবাসার বন্ধন হতে হবে একজনের সাথে। দেখ, তুমি প্রেম করতে চাও।
তুমি কি দুজন প্রেমাষ্পদের সঙ্গে প্রেম বিনিময় করবে, এতো বড়ই গর্হিত, খেয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এমন তো হতে পারে না যে, মানুষ শয়তানকে ভালোবাসবে আবার রহমান আল্লাহর সাথেও ভালোবাসার বন্ধন স্থাপন করবে। এখানে নিম্নোক্ত আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো মানুষের অভ্যন্তরে দুটি হৃদয় সৃষ্টি করেননি।’ (সুরা আহজাব: আয়াত-৪)।
চিন্তা করো, তোমাকে পুঁজি দেয়া হয়েছে জ্ঞানের, বুদ্ধির ও বিবেচনার। তুমি যদি এই পুঁজি তুমি দুনিয়া অর্জনের পেছনে উজাড় করে দাও, তাহলে অবশ্যই তোমার এই ব্যবসা গোল্লায় যাবে, তুমি দেউলিয়া হয়ে যাবে। কেননা, লোভ মানুষকে অন্ধ করে। সাবধান! দুনিয়ার লোভ তুমি সামাল দাও। লোভ তোমাকে অন্ধদিল বানায়। প্রকৃত সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করে। লোভের ফাঁদে ফেলে শয়তান কাঁধে সওয়ার হয়। পরে নিজে যেভাবে বিতাড়িত হয়েছে সেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত, বিতাড়িত ও অপদস্থ করে। কাবাঘর ধ্বংস করতে আসা হস্তি বাহিনী এবং সমকামিতায় আসক্ত জাতি লুত সম্প্রদাযের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা কর। শিক্ষা নাও। একমাত্র ধৈর্যই তোমাকে এসব পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার শক্তি যোগাতে পারে। কেননা, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ (সুরা আনফাল : ৪৬)। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৪৩০-১৪৭২)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)