সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে অন্যায় কথা, অসত্য ও বিকৃত কথা, বিদ্বেষ ও সম্মানহানির কথা প্রচার করা হয়, তা শরিয়তের দৃষ্টিকোণে নিন্দনীয় ও জঘন্য কাজ। গতকাল ৮ নভেম্বর শুক্রবার জুমার বয়ানে তাকওয়াবিষয়ক আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক এসব কথা বলেন। বয়ানের সংক্ষিপ্ত অনুলিখন পেশ করা হলো :
আল্লাহতায়ালা মোমেননদের তাকওয়া অর্জন করতে বলেছেন। এরপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান দিয়েছেন, তাহলো সঠিক কথা বলা। সঠিক কথা মানে হচ্ছে, মিথ্যার মিশ্রণ এবং ভুলের মিশ্রণ ছাড়া সঠিক সত্য কথা। এই আদেশের ব্যাখ্যা কোরআনের অন্য এক আয়াতে এসেছে, অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার জানা নেই তার পেছনে পড়ো না। কারণ তোমার কান, চোখ এবং অন্তর সব বিষয়েই কেয়ামতের দিন তোমাকে প্রশ্ন করা হবে। মানুষের কথা বলার বিধান ও পদ্ধতি কী কোরআনের দুই আয়াতে তা বলে দেয়া হয়েছে। আজকে আধুনিক সমাজে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে অন্যায় কথা, অসত্য কথা, বিকৃত কথা, বিদ্বেষ ও সম্মানহানির কথা প্রচার করা হচ্ছে, তা শরিয়তের দৃষ্টিকোণে নিন্দনীয় জঘন্য কাজ। আমি নিয়োগের পরে প্রথম জুমা পড়াইনি, তবুও সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার জুমার বয়ান নামে কি আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে! প্রথম জুমার দিনও যে আলোচনা করেছি তার পরিবর্তে অন্য একটি আলোচনাকে প্রথম জুমার বয়ান নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার নামান্তর। অনেকে ভাবতে পারে আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে শরিয়তের কোনো নীতিমালা নেই। অথচ সাড়ে ১৪০০ বছর আগে এ সকল বিধান কোরআন এবং সুন্নাহয় দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের কর্তব্য হলো, যখন যে সমাজে যে অবস্থা ও পরিস্থিতি আসে তার বিধান ও নীতিমালা কোরআন এবং সুন্নাহ থেকে জেনে নেয়া।
কথা শেয়ার করার বিধান : যেকোনো কথা পেলেই বা তথ্য জানলেই তা অন্যদের জানিয়ে দেয়া বা শেয়ার করা মোমেনের আলামত নয়, এটি মিথ্যাবাদী হওয়া, গুনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ট। হাদিসে এই বিষয়ে কঠিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে। বরং এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো : ১. তথ্যসূত্র যাচাই করা। ২. তথ্যের বিষয়বস্তুর সত্যতা ও বিশুদ্ধতা যাচাই করা। ৩. সঠিক ও বিশুদ্ধ হলেও তথ্যটি সাধারণ জনগণের জন্য উপকারী কিনা তা বুঝা। ৪. যদি কোন বিশেষ আমানতের তথ্য থাকে, তবে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে না জানানো। যদি সত্যিকার অর্থেই কোনো বিষয় সকলের জন্য উপকারী হয় তাহলে তা শেয়ার করা অন্যথায় চুপ থাকা।
হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাস রাখে সে যেন কম কথা বলে, অথবা চুপ থাকে। কারণ চুপ থাকলে তার সওয়াব না হলেও গুনাহ হবে না।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, পাণ্ডিত্য নেই, বিশেষজ্ঞতা নেই, সে যেন সেই বিষয়ে কোনো কথা না বলে, না লিখে। আরেকটি হাদিসে এই বিষয়ে গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে, (অর্থ) ‘মুসলিম হলো ওই ব্যক্তি, যার জিহবা ও হাত থেকে মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ এই জিব্বা আকৃতিতে ছোট কিন্তু তার অপরাধ অনেক বড়। আজকের আধুনিক যুগে গণমাধ্যম ও যোগাযোগমাধ্যমে এই জিহবা ও হাত দ্বারা অনেক রকম অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। মোবাইলে টাচ করা হোক, কম্পিউটারে কিবোর্ডে লেখা হোক বা মুখে বলা হোক কিংবা মাইকে আলোচনা করা হোক সব ক্ষেত্রেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
জুমার মসজিদে আদব : জুমার দিন অনেকেই ধাক্কাধাক্কি করে, সামনে আসার জন্য অন্যদের কষ্ট দেয়, এটি গুনাহের কাজ। বিদায় হজের সময় আল্লাহর রাসুল বলেছিলেন, ‘কাউকে ধাক্কা দিও না কষ্ট দিওনা।’ বিশেষ করে কোন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে সম্মান দেয়ার জন্য বা এগিয়ে নেওয়ার জন্য রাস্তা ফাঁকা করতে যেয়ে অন্যকে কষ্ট দেওয়া বা ধাক্কা দেওয়া নিন্দনীয় কাজ। একবার একজন রাসুলুল্লাহর মজলিসে মানুষকে ডিঙিয়ে আসছিল, তখন তিনি তাকে বলেছেন, ‘তুমি যেখানে আছো সেখানে বসে পড়ো, তুমি দেরিতে এসে আবার মানুষকে কষ্ট দিচ্ছ।’ এজন্য এগুলো আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
সত্য বলার পুরস্কার : আল্লাহপাক কোরআনে বলেন, মানুষ যখন অন্তর থেকে আল্লাহকে ভয় করবে এবং সঠিক ও সত্য কথা বলবে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং তার আমলকে সুন্দর করে দেবেন। আর যে আল্লাহকে এবং তার রাসুলকে অনুসরণ করবে সে সফলকাম হয়ে গেল।
আল্লাহ ও রাসুলকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্য : আল্লাহকে অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহর আদেশকৃত সকল বিধান মেনে চলা এবং সকল নিষেধকৃত কাজ থেকে বিরত থাকা। রাসুলকে অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে, রাসুলের সুন্নাহকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা। আজকে এই সময় এই শহরে এই সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা হাদিসকে অনুসরণ করতে চায় না, মানতে চায় না। অথচ রাসুলের হাদিসকে অস্বীকার করা সুন্নাহকে অস্বীকার করা রাসুলকে অবমাননার নামান্তর। রাসুলের সুন্নাহকে অস্বীকার করলে এবং তাকে শরিয়তের বিধান মনে না করলে তার ঈমান থাকবে না। কেউ যদি সুন্নতের পরিবর্তে বিদাতকে গ্রহণ করে, অথবা সুন্নত পরিপন্থি কোন মতাদর্শ লালন করে, তাহলে সে প্রকৃত রাসুলের অনুসারী হবে না। আল্লাহতায়ালা আমাদের আমাদের জবান ও হাতকে হেফাজত করে উত্তম কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহ ও তার রাসুলের পরিপূর্ণ অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন।
অনুলিখন : মাওলানা ফজলে রাব্বি আফনান