ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হালাল রিজিকের উপকারিতা

মাহবুবুর রহমান
হালাল রিজিকের উপকারিতা

হালাল রিজিক কী? হালাল অর্থ হলো বৈধ বা অনুমোদিত, আর রিজিক অর্থ জীবিকা বা জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ। হালাল রিজিক মানে এমন উপার্জন যা ইসলামিক বিধান অনুযায়ী বৈধ উপায়ে অর্জিত এবং যার মধ্যে হারাম বা অবৈধ কিছু নেই। এর অর্থ হচ্ছে এমন কোনো উপার্জন গ্রহণ করা যাবে না, যা আল্লাহ এবং তার রাসুল (সা.) নিষিদ্ধ করেছেন।

হালাল রিজিকের গুরুত্ব : ইসলামে হালাল রিজিক বা বৈধ উপার্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহতায়ালা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল এবং হারাম পার্থক্য করে দিয়েছেন। রিজিক তথা জীবনযাপনের উপকরণে হালাল এবং পবিত্র উপায় অবলম্বনের গুরুত্ব দিয়ে ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে। হালাল রিজিক গ্রহণ এবং হারাম থেকে বিরত থাকা ইসলামের মৌলিক নীতির অন্তর্ভুক্ত। হালাল রিজিক গ্রহণ করা তাসাউফের মূলশিক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। আমরা কেন হালাল রিজিক গ্রহণ করব? হালাল রিজিকের উপকারিতা কী? এর কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো-

১. আল্লাহর নির্দেশ পালন : কোরআন এবং হাদিসে বহুবার হালাল রিজিকের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা নিজে আমাদের জন্য হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন শুধু হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জীবনযাপন করতে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের উপার্জন থেকে এবং আমি পৃথিবীতে যা তোমাদের জন্য হালাল ও পবিত্র করেছি, তা থেকে আহার করো’ (সুরা আল-বাকারা : ১৬৮) ।

২. ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত : হালাল রিজিক ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলামে হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জীবনযাপন না করলে ইবাদত কবুল হওয়ার সুযোগ কমে যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রিজিক খাও তাহলে তোমার দোয়া কবুল হবে।’ যদি কেউ হারাম উপার্জন করে তবে আল্লাহ তার দোয়া ও ইবাদত কবুল করেন না।

৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাকওয়ার বিকাশ : ইসলামে হালাল রিজিক গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সহজ হয়। আল্লাহর ভয়ে নিজের উপার্জন বৈধ পন্থায় সীমাবদ্ধ রাখা তাকওয়ার পরিচায়ক, যা একজন মুসলিমের ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষ করে রিজিকের ক্ষেত্রে। হালাল রিজিক গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছাকাছি হতে পারি এবং এর মাধ্যমে ঈমান আরও শক্তিশালী হয়।

৪. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বরকত লাভ : হালাল উপার্জনের কারণে পরিবারে বরকত হয় এবং আল্লাহতায়ালা পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রদান করেন। হালাল রিজিকের ফলে পরিবারের সদস্যরা ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী হয় এবং তাদের মন ও মনের ভাব আল্লাহর পথে থাকে। পক্ষান্তরে হারাম উপার্জন সংসারে অশান্তি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। হালাল উপার্জন শুধু ব্যক্তি নয়, পরিবার ও সমাজের জন্যও উপকারজনক।

৫. নৈতিক ও নৈতিকতার উন্নয়ন : ইসলামে হালাল রিজিক গ্রহণের গুরুত্ব হচ্ছে এটি আমাদের নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনে সহায়ক হয়। একজন সৎ ব্যক্তি হালাল উপায়ে উপার্জন করে সমাজে মর্যাদা পায় এবং মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। সৎ উপার্জনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সৎ গুণাবলির উন্নয়ন হয় এবং সমাজে সুনাম অর্জন করা যায়। ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ, সেবামূলক পেশা ইত্যাদি বৈধ উপায়ে উপার্জন করার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এতে একজন মুসলিমের নৈতিকতা দৃঢ় হয় এবং এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে শুদ্ধাচারিতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

৬. হারাম রিজিকের প্রভাব থেকে মুক্তি : হারাম উপার্জনের কারণে মানুষের অন্তর কঠিন হয়ে যায় এবং তারা সহজেই পাপের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

হারাম উপার্জন থেকে বিরত থাকার ফলে একজন মুসলিমের মন ও মনন বিশুদ্ধ থাকে এবং তার আত্মা আল্লাহর পথে স্থির থাকে। ইসলামে হারাম রিজিককে শয়তানের পথ বলা হয়েছে, যা একজন মুসলিমের জীবন ও ঈমানের জন্য ক্ষতিকর। হারাম উপার্জন মানুষের অন্তরে দুঃশ্চিন্তা, অস্থিরতা এবং পাপের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। এ কারণে ইসলামে হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

৭. আখেরাতে পুরস্কার লাভের প্রতিশ্রুতি : ইসলামে বলা হয়েছে, যারা সৎপথে হালাল উপার্জন করে এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলে, তাদের জন্য জান্নাতে বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের জন্য আখেরাতে আল্লাহর কাছে মর্যাদা ও সম্মানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য চেষ্টা করা একপ্রকার ইবাদত।’ অতএব, হালাল রিজিক আখেরাতে সফলতা লাভের মাধ্যম এবং এর দ্বারা একজন মুসলিম আল্লাহর কাছ থেকে মাগফিরাত ও রহমত অর্জন করতে পারে।

৮. মানসিক প্রশান্তি লাভ : হালাল রিজিকের মাধ্যমে একজন মুসলিম মানসিক প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। বৈধ উপায়ে উপার্জন করার ফলে মানুষ অভ্যন্তরীণ শান্তি অনুভব করে এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ফলে অন্তরে শান্তি ও সুখ বজায় থাকে। আর হারাম রিজিক গ্রহণের ফলে একজন মুসলিম সর্বদা মানসিক চাপে থাকে। কারণ সে জানে তার উপার্জন অবৈধ এবং আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাই, হালাল রিজিক গ্রহণের মাধ্যমে একজন মুসলিমের জীবনে প্রশান্তি ও মানসিক প্রফুল্লতা আসে।

৯. জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া : আল্লাহতায়ালা আমাদের জীবনকে পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। কখনো আর্থিক সংকটে রেখে তিনি আমাদের ধৈর্য ও ঈমানের পরীক্ষা নেন। হালাল পথে থাকা এবং তার বিধান মেনে চলা এক ধরনের পরীক্ষা, যা একজন মুসলিমকে আখেরাতে সফলতা এনে দেয়। তাই একজন মুসলিম যখন হালাল রিজিকের পথে থাকে, তখন সে তার জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আখেরাতের জন্য উত্তম প্রতিদান পায়।

১০. আত্মার পবিত্রতা : হালাল রিজিক আত্মাকে পবিত্র ও পরিষ্কার রাখে। হালাল রিজিক থেকে অর্জিত খাদ্য গ্রহণ করলে মানুষের অন্তর ও আত্মা শান্তিতে থাকে এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে সহায়তা করে। এটি মানবের নৈতিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে।

১১. সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা : হালাল রিজিক গ্রহণের ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। কারণ, হারাম রিজিক মানুষের মধ্যে লোভ, হিংসা ও অপরাধের প্রবণতা বাড়ায়। হালাল উপার্জনের মাধ্যমেই সমাজে সুস্থ পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং মানুষ একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।

১২. পরকালে সফলতা অর্জন : যারা হালাল রিজিক গ্রহণ করেন, তারা আখিরাতে সফলতা লাভ করেন। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক নিকটবর্তী হবে, যে ব্যক্তি নিজের হালাল রিজিক উপার্জনের চেষ্টা করেছে এবং নিজেকে হারাম থেকে দূরে রেখেছে।’

হালাল রিজিক গ্রহণের পদ্ধতি

১. সৎ ও বৈধ কাজ করা : নিজের রিজিক উপার্জনে সবসময় সৎ ও বৈধ পেশা অবলম্বন করা উচিত। যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, কৃষিকাজ বা যে কোনো পেশা যা শরিয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

২. জালিয়াতি ও প্রতারণা থেকে দূরে থাকা : ইসলামে প্রতারণা, মিথ্যা বলা, ওজনে কম দেওয়া ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে কোনো কাজেই সততা অবলম্বন করে কাজ করা উচিত।

৩. সুদ ও ঘুষ থেকে বিরত থাকা : ইসলামে সুদ এবং ঘুষ গ্রহণ করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। ব্যবসায় বা চাকরির ক্ষেত্রেও সুদ বা ঘুষের লেনদেন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে।

৪. অন্যের অধিকার সংরক্ষণ : ইসলামিক আইন অনুযায়ী অন্যের সম্পত্তি বা অধিকার হরণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রিজিক উপার্জনে সততার সঙ্গে কাজ করলে আল্লাহতায়ালা তার বরকত দান করেন।

হারাম রিজিকের নেতিচাবক প্রভাব

১. দুঃশ্চিন্তা ও অশান্তি : হারাম রিজিক গ্রহণ করলে মানুষ মানসিক শান্তি হারায়। আল্লাহতায়ালা হারাম উপার্জনের কারণে দুঃশ্চিন্তা, বিপদ ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেন।

২. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অশান্তি : হারাম রিজিকের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ঝামেলা দেখা দেয়। হারাম রিজিক পরিবারে কল্যাণ ও বরকত কমিয়ে দেয়।

৩. ইবাদত কবুল না হওয়া : হারাম রিজিক গ্রহণের ফলে মানুষের ইবাদত ও দোয়া কবুল হয় না। আল্লাহ হারাম রিজিক থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

৪. পরকালীন শাস্তি : হারাম রিজিক গ্রহণকারীদের আখেরাতে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ইসলামি আইন অনুযায়ী তারা আল্লাহর নিকট অপ্রিয় হিসেবে বিবেচিত হন এবং আখেরাতে তাদের জান্নাত থেকে বঞ্চিত করা হবে।

মুসলমান মাত্রেরই হালাল রিজিক গ্রহণ করা আবশ্যক। হালাল রিজিক গ্রহণ করলে ইবাদতে স্বাদ আসে। দোয়া কবুল হয়। আল্লাহর নৈকট্যশীল হওয়া যায়। তাই সদা মনে রাখতে হবে, ইসলামে হালাল রিজিক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা শুধু বর্তমান জীবনে নয়, আখেরাতেও সফলতা লাভের মাধ্যম।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রভাষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত