ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২১৬)

আদমের (আ.) কায়া তৈরির প্রস্তুতি যেভাবে

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আদমের (আ.) কায়া তৈরির প্রস্তুতি যেভাবে

মহান স্রষ্টা ইচ্ছা করলেন পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করবেন। উদ্দেশ্য, কর্মক্ষেত্রে পরীক্ষায় ফেলে তিনি প্রমাণ করবেন কে ভালো বা কে মন্দ, কার আমল উত্তম। সুরা মুলকে যেমনটি বলা হয়েছে, ‘যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের মধ্যে কর্র্মে কে উত্তম তা পরীক্ষা করার জন্য, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক : আয়াত-২)। আল্লাহ পাক জিবরাঈলকে (আ.) বললেন, যাও গিয়ে জমিন থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে এসো। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে জিবরাঈল (আ.) প্রস্তুত। উড়াল দিয়ে নেমে এলেন পৃথিবীতে। আল্লাহর আদেশের একান্ত অনুগত জিবরাঈল (আ.) হাতখানা প্রসারিত করলেন মাটি তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু মাটি নিজেকে গুটিয়ে নিল, ভীষণ সতর্কতা দেখাল। মাটি কাতরভাবে করুণ সুরে বলতে লাগল, মহান স্রষ্টা আল্লাহর সম্মানের দোহাই, জিবরাঈল! আমাকে দয়া করে মাফ করুন। কঠিন বিপদের সম্মুখীন করবেন না আমাকে। আপনি আমাকে যেখানে নিতে চাচ্ছেন তা দায়িত্ব পালনের বিপদসংকুল প্রান্তর। আমাকে দিয়ে যে মানুষ তৈরি করা হবে তার উপর ন্যস্ত হবে কঠিন আমানতভার। সে আমানত রক্ষা করতে মানুষকে কঠিন থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। কাজেই আমাকে মাফ করুন। সেই ময়দানে নিয়ে যাবেন না আল্লাহর দোহাই। এই আমানতভারের কথা পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে

‘আমি তো আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শংকিত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করল। সে তো অতিশয় জালিম, বেভুল অজ্ঞ।’ (সুরা আহযাব : ৭২)। মাটি জিবরাঈলকে (আ.) বুঝাতে চাইল, এতবড় আমানতভার, যা অবুঝ মানুষ পাগলামি করে মাথায় নেবে সে মানুষের কায়া আমাকে দিয়ে তৈরি হবে, তা ঠিক হবে না। আমি সেই ধকল সইতে পারব না। আপনার প্রতি আল্লাহতায়ালা বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন, আপনাকে আল্লাহ নিজের দূত নির্বাচন করেছেন, লওহে মাহফুযের জ্ঞান দ্বারা আপনাকে আলোকিত করেছেন, আপনাকে ফেরেশতাদের শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েছেন, আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য আপনার কপালেই লেখা। আল্লাহর অনুগ্রহের কারণে আপনি পৃথিবীতে নবী-রাসুলগণের (আ.) কাছে দূত হবেন, তাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিবেন। ওহিনির্ভর আত্মিক জীবন, যে রুহে নবী-রাসুলগণের (আ.) কাছে ওহি আসবে আর আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে ইলহাম আসবে সেই রুহানি জীবনের নিয়ামক আপনি। অপর সম্মানিত ফেরেশতা ইসরাফিল (আ.)-এর চেয়ে আপনি শ্রেষ্ঠ। তার কারণ ইসরাফিল মানুষের দৈহিক জীবনের ব্যবস্থাপক আর আপনি রুহানি জীবনের ব্যবস্থাপক। মানব দেহের নিয়ন্ত্রক যে প্রাণ সেই প্রাণেরও প্রাণ আছে। সেই প্রাণের নিয়ন্ত্রণ আপনার মাধ্যমে। কাজেই আপনি মানুষ বানানোর কাঁচামাল হিসেবে আমাকে নেবেন না। আপনার মর্যাদা অনেক উচ্চে, দয়া করে এমন কাজটি করবেন না।

বা’ঙ্গে সূরাশ নাশআতে তানহা’ বুয়াদ

নাফখে তো নাশবে দেলে য়্যকতা’ বুয়াদ

ইসরাফিলের শিঙ্গায় জেগে উঠে দেহের প্রাণ

আপনার ফুৎকারে জাগে প্রাণের একক প্রাণ।

মওলানা রুমি (রহ.) বুঝাতে চান, মানুষের দুটি জীবন। একটি দেহনির্ভর। আরেকটি রুহনির্ভর আত্মিক জীবন। দৈহিক জীবনের চেয়ে আত্মিক জীবন শ্রেষ্ঠতর। আল্লাহর মহিমান্বিত ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) আত্মিক জীবনের ব্যবস্থাপক। এ জন্যে তার নিয়ন্ত্রণে দেয়া হয়েছে জ্ঞানের ভান্ডার। ‘লওহে মাহফুয’ ঊর্ধ্বলোকের সংরক্ষিত ফলক পাঠ করার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে তাকে। আর সৃষ্টিলোকের দৈহিক জীবন নিয়ন্ত্রণের ভার মিকাঈল (আ.)-এর উপর অর্পিত। মওলানার ভাষায় মাটি জিবরাঈলকে (আ.) বলে, মিকাঈল মানুষের দেহের খোরাক যোগায় আর আপনি রুহের খোরাক যুগিয়ে হৃদয়জগৎ আলোকিত করেন। মিকাঈলের ঝুলি এমন দান-দাক্ষিণ্যে ভরপুর, যা ওজন দেয়া যায়, পাত্রে মাপা যায়। কিন্তু আপনার দানের ভান্ডারে এমন সব রত্ন আছে, যা পরিমাপ করা যায় না, ওজন দেয়া সম্ভব নয়।

আপনাকে দেয়া রহমত যদি আজরাঈলকে (আ.) দেয়া ক্রোধের সাথে তুলনা করা হয়, তাতেও আপনি শ্রেষ্ঠ। কারণ, আজরাঈল (আ.) ধ্বংস ও নিধনের প্রতীক। আল্লাহর কহর ও গজব, ক্রোধ ও প্রতাপ গুণের ঝলক আজরাঈলের উপর প্রতিফলিত। আর আপনাকে দেয়া হয়েছে রহমত ও সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহের নিয়ন্ত্রণকাঠি। আল্লাহর রহমত তো আল্লাহর গযব ও ক্রোধের উপর অগ্রগামী। এ দিক থেকেও আপনার মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। এখন আল্লাহর আরশ বহনকারী চারজন ফেরেশতার মধ্যে আপনি শ্রেষ্ঠ। হাশরের দিন আল্লাহর আরশ বহন করবেন আটজন ফেরেশতা। সেই আটজনের মধ্যেও আপনি হবেন শ্রেষ্ঠ। এভাবে মাটি কান্নাকাটি করছিল আর জিবরাঈলের শ্রেষ্ঠত্বের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিল। মাটির কান্না আহাজারী দোহাই আর অনুরোধ-অনুযোগের ফলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতের বাহক জিবরাঈল (আ)-এর মন গলে যায়। কারণ, তিনি ছিলেন অসম্ভব লাজুক, শরমের খনি। আল্লাহর নামে শপথ আটকে দিল তার গতি। খালি হাতে পৃথিবীর বুক থেকে চলে গেলেন আল্লাহর কাছে। বললেন,

কে নাবুদাম মন বে কা’রত সারসারি

লেকে যানচে রফত তো দা’না’ তরি

তোমার কোনো কাজে গাফলতি আমি করিনি প্রভু

কিন্তু জমিনে যা ঘটে গেল তুমিই তো জান ভালো।

আমি তোমার আদেশ পালনে কখনো অলসতা দেখাইনি। যত বড় কাজ আঞ্জাম দিয়েছি প্রবল পরাক্রমে; কিন্তু এবার তোমার আদেশ পালন করতে গিয়ে কী ঘটে গেল তুমিই তো ভালো জানো। আমার তো খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাটি আমাকে বলেছে, আল্লাহর দোহাই। প্রভু হে! মাটি এমন একটি নাম উচ্চারণ করল, যার প্রতাপে সাত আসমানের ঘূর্ণন পরিক্রমন স্তব্দ হয়ে যায়। মহান প্রভুর নিরানব্বইটি নাম আছে, এগুলো তার গুণাবলির সৌন্দর্য ও প্রতাপের পরিচায়ক। এর কোনো কোনো নামের ভাবার্থে যে ধারণ ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য আছে তার বদৌলতে অন্য নামের উপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখে। কিন্তু তার একটি পবিত্র নাম আছে, যা সত্তাগত, যার মহিমার শেষ নেই। সে নামের মধ্যে শামিল আছে গুণবাচক নিরানব্বই নাম। নির্দিষ্ট গুণবাচক নামগুলো এই নামেরই অংশ, ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। এই হিসেবে এই নাম নামসমূহের রাজা। এই নামে মহান প্রতিপালকের সব গুণ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব একত্রে বুঝায়। নিরানব্বই গুণবাচক নাম এই নামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেই সুবাদে পবিত্র নামসমূহের কাবাঘরতুল্য এই মহান নাম। তোমার সেই নামের দোহাই দিয়েছে মাটি। সে নাম মোবারকের উচ্চারণ শুনে আমি বিগলিত হয়ে গেছি।

শারমাম আ’মদ গাশতাম আয না’মত খাজেল

ওয়ার না আ’সা’ন আস্ত নকলে মুশতে গেল

তোমার নাম শুনে লজ্জায় হয়েছি জড়োসড়ো

নচেৎ এক মুঠো মাটি তুলে আনা সহজ ছিল।

কারণ, তুমি ফেরেশতাদের এমন ক্ষমতা দিয়েছ, যার সাহায্যে পৃথিবী কেন আকাশমণ্ডলও চৌচির করতে পারে তারা। সত্য বলতে কী, তোমার পবিত্র সত্তাগত নাম ‘আল্লাহ’ উচ্চারণের সাথে সাথে আমার ডানার শক্তি রহিত, নিথর নিস্তেজ হয়ে গেছি। মহান রাব্বুল আলামীন এবার মিকাঈল ফেরেশতাকে ডেকে বললেন, আমাকে মানুষ বানাতে হবে, সে মানুষ হবে মানব জাতির পিতা ‘আবুল বাশার’। পৃথিবীতে আমার খলিফা হবে সে। তাকে ফেরেশতারা সবাই সিজদা করবে, ফেরেশতাদের শিক্ষক হবে। তাকে আমি বানাতে চাই মাটির নির্যাস থেকে। তুমি বীরবেশে ক্ষিপ্রগতিতে এক মুঠো এঁটেল মাটি নিয়ে এসো জমিনে গিয়ে। মিকাঈল (্আ.) আসমান থেকে নেমে এসে হাত দিলেন মাটির গায়ে। মাটি আঁতকে ডুঁকরে উঠল প্রচণ্ড ভয়ে। কান্নায় অশ্রুপাতে বুক ভাসিয়ে অনুনয় করল, সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে বানিয়েছেন মহান আরশের ভারবাহী। দুনিয়ার মানুষের কার কীভাবে কত পরিমাণ আহার রিজিক প্রয়োজন তার রহস্যজ্ঞানী আপনি। আপনি আমাকে রেহাই দিন। আমার চোখের দিকে তাকান কীভাবে রক্ত মেশানো অশ্রু ঝরছে দেখুন।

মওলানা রুমি বলেন, ফেরেশতারা হলেন আল্লাহর রহমতের খনি। জিন-দৈত্যরা আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের উদ্ভাস। মাটির ক্রন্দন বিলাপ দেখে মিকাঈল তো তাজ্জব। বললেন, আমি কীভাবে বান্দার বিক্ষত হৃদয়ের ঘায়ে নুন ছিটাব। হে তরুণ! জেনে রেখ, আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের উপর রহমত শক্তিশালী। হ্যাঁ, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন লোকও আছেন যাদের অন্তরে আল্লাহর রহমতের ঢেউ প্রবল। মিকাঈল আরশের মালিকের কাছে গিয়ে জানালেন, প্রভুহে বান্দার আনন্দ-নিরানন্দ তোমার সব জানা। মাটির চোখের পানি দেখে আমি সইতে পারিনি। খালি হাতে ফিরে এসেছি।

তোমার কাছে বান্দার চোখের পানির কী মূল্য আমি জানি। সে কারণে আমি উপেক্ষা করতে পারিনি তার ক্রন্দন। তুমিই তো বান্দাকে দৈনিক পাঁচবার কাঁদার আহ্বান জানিয়েছ। মুয়াজ্জিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান তো সেই কান্নার আহ্বান। তুমি যাকে দুঃখ-দুশ্চিন্তায় জর্জরিত রাখতে চাও, কেবল তাকেই ক্রন্দন, অশ্রু বিসর্জন হতে মাহরুম করে রাখ। যাতে কোনো বালা-মুসিবত নেমে এলে ক্রন্দন আহাজারীকে উসিলা বানিয়ে মুক্তির পথ খুঁজে না পায়।

ওয়াঙ্কে খা’হী কায বালাআশ ওয়াখারি

জা’নে উ রা’ দর তাজাররু আ’ওয়ারী

আর যাকে উদ্ধার করতে চাও বালা-মুসিবত হতে

তাকে নিয়োজিত কর কান্নায় কাতর আর্তনাদে।

বিপদ থেকে মুক্তির পথ আল্লাহর কাছে কাতরকণ্ঠে ক্রন্দন, অশ্রুবিসর্জন। এ কারণে যুগে যুগে যারা আল্লাহর অবাধ্য নাফরমান হয়েছে, যারা কাফের মুশরিক তারা এই ক্রন্দন থেকে বঞ্চিত ছিল। কোরআন মাজিদে এর বহু প্রমাণ আছে। ‘আপনার পূর্বেও আমি বহু জাতির নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি; অতঃপর তাদের অর্থসংকট ও দুঃখ ক্লেশ দ্বারা পীড়িত করেছি, যাতে তারা আমার কাছে কান্নাকাটি করে। আমার শাস্তি যখন তাদের উপর আপতিত হলো- তখন তারা কেন কান্নাকাটি করল না? অধিকন্তু তাদের হৃদয় কঠিন হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল। (সুরা আনআম : ৪২-৪৩)। তাদের অন্তরগুলো এমন কঠোর হয়েছিল যে, তারা যেসব পাপাচার করত সেগুলোকে মনে করত ইবাদত-উপাসনা শোভন কল্যাণময়। নাফরমানরা যতক্ষণ নিজের অপরাধ উপলব্ধি না করবে তাদের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াবে কীভাবে?

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৫৫৬-১৬০৭)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত