বায়তুল মোকাররাম জাতীয় মসজিদের জুমার খুতবায় মুফতি আব্দুল মালেক বলেন, ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে নারী ও শিশুর সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সবপেশা শ্রেণির মানুষের অধিকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনিশ্চিত করতে হবে। এটাই ইসলাম ও প্রকৃত মানবতা। আজকাল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকারের কথা খুব শোনা যাচ্ছে; কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিরাপত্তা ও অধিকারের কথা বলা হয় না। কেমন যেন বোঝাতে চায়, এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর অত্যাচার হয় না। চট্টগ্রামের তাওহিদবিরোধীদের হাতে তাওহিদের কালেমা পাঠ করার অপরাধে শহিদ সাইফুল ইসলাম আলিফের জন্য অনেককে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। কেমন যেন তাকে নিশংসভাবে হত্যা করা কোনো নির্যাতনের মধ্যে পড়ে না। অথচ ইসলামে সকল নাগরিকের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান ও অধিকার আদায়ের কথা রয়েছে।
খতিব আব্দুল মালেক বলেন, আমরা সংখ্যালঘু, নির্যাতন ও অধিকার ইত্যাদি শব্দ অনেক ব্যবহার করি। কিন্তু সঠিকভাবে এগুলোর মর্মার্থ বুঝি না। যার ফলে সম্প্রীতি, ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিষয়ে আমরা বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তির শিকার। এ প্রসঙ্গে তিনি সুরা মায়েদার দ্বিতীয় আয়াতের শেষ অংশ নিয়ে আলোচনা করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আল্লাহতায়ালা নেক কাজ এবং তাকওয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন এবং গুনাহ ও অন্যায় অবিচারের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে নিষেধ করেছেন।’
সমাজের যেকোন নাগরিক মুসলিম বা অমুসলিম যেই হোক, সে যদি কোনো কল্যাণের কাজ করে তাহলে তাকে সহযোগিতা করা ও সমর্থন করা ইসলামের নির্দেশ। মক্কার কাফেররা ইসলামপূর্ব যুগে একটি চুক্তি করেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল মক্কার আশেপাশে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে তাকে সহযোগিতা করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই চুক্তির অংশ ছিলেন। পরবর্তীতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ যুগেও তিনি ঘোষণা করেছেন, এখনো কেউ যদি আমাকে অনুরূপ কোন চুক্তিতে ডাকে তাহলে আমি সেই ডাকে সাড়া দেব। অপরদিকে সমাজের যেকোন নাগরিক মুসলিম বা অমুসলিম যেই হোক, সে যদি কোন অন্যায়-অনাচার করে, তাহলে তা বাধা দেওয়া ইসলামের নির্দেশ।
হাদিসের ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার ভাইকে জালিম ও মজলুম উভয় অবস্থায় সহযোগিতা করো।’ মাজলুম যেই হোক না কেন, তার পক্ষে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আর জালেম যেই হোক না কেন, তাকে জুলুম থেকে প্রতিহত করতে হবে। এটাই তাকওয়ার শিক্ষা। আলোচ্য আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন, আল্লাহর শাস্তি অনেক কঠিন। এটি সকলপ্রকার জালিমদের জন্য একটি ভীতিকর নির্দেশনা। জালেম যত বড় ক্ষমতাধর হোক না কেন, আল্লাহর আজাব যখন আসে, তখন খুব সামান্য কারণেও তাকে লাঞ্ছিত অপদস্থ ঘৃণিত হতে হয়। দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশি মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল, তাই তারা দ্রুতই অতীতের ঘটনা ভুলে যায় এবং একই রকম কাজ পুনরায় করতে থাকে।
খতিব মুফতি আব্দুল মালেক জুমাপূর্ব বয়ানে জুলুমের বিভিন্ন প্রকাশক্ষেত্র উল্লেখ করে বলেন, আমাদের সমাজে নারী ও শিশুদের ওপর বিভিন্ন রকম নির্যাতন হয়ে থাকে। এটি অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন মারাত্মক কবিরা গুনাহ এবং আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা। যে নারী আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে আমি একদিন ছোট্ট শিশু ছিলাম, সে একজন নারীই কোলেপিঠে করে আমাকে প্রতিপালন করেছেন, সেই নারী জাতির প্রতি অবিচার করা বিবেক সায় দেয় কীভাবে? শিশুদের প্রতি অবিচার কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাজ নয়। তাই ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নারী ও শিশুর সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, আমরা বাহ্যিকভাবে যেগুলোকে নির্যাতন বা অবিচার মনে করি, এর বাইরেও অনেক ধরনের জুলুম অবিচার এবং নির্যাতন রয়েছে। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুকে অমুসলিম বা খ্রিষ্টান স্কুলে ভর্তি করা, শিশুকে কোরআন-সুন্নাহ ও দীন না-শেখানো এক প্রকার নির্যাতন। কন্যাকে অবহেলা করা, পারিবারিক বা সামাজিকভাবে হেয় করা, অথবা পর্দার সাথে দ্বীন পালন করতে না দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্দানশীন নারীকে অপদস্থ করা এসব নারী ও শিশু নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত। আজকের যুগে নারীবাদীরা নারী অধিকারের নামে নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন করছে। আমরা দেশের সকল পত্র-পত্রিকা টিভি চ্যানেল ও রাস্তাঘাটের বিজ্ঞাপন-বিলবোর্ডে নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন করার প্রতিবাদ করছি। এসব অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ইসলামে নারীর ন্যায্য অধিকার বিষয়ে সুবিন্যস্ত বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। আমরা এগুলোকে আল্লাহর বিধান হিসেবেই মানি। তবে এগুলো নিয়ে সংশয় সৃষ্টিকারী তথাকথিত নারীবাদীরা চাইলে আমরা তাদের চ্যালেঞ্জ দিতে প্রস্তুত আছি, ইনশাআল্লাহ।
অনুলিখন : লুতফে রাব্বি আফনান