ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২২২)

নিখাদ অন্তরের তাওবাতান নাসুহা

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
নিখাদ অন্তরের তাওবাতান নাসুহা

তার নাম ছিল নাসূহ। পুরুষ অথচ দেখতে মেয়েলোক। চেহারায় মেয়েলী অবয়ব। কথাবার্তায় নারীকণ্ঠের সুরেলা আমেজ। পুরুষত্ব লুকিয়ে কাজ নিয়েছিল মেয়েদের গণগোসলখানা হাম্মামে। স্নানকালে অভিজাত মেয়েদের শরীর ঘঁষেমেজে দিত চতুর হাতে। একদিকে তার জীবিকা নির্বাহ অন্যদিকে কামনা চরিতার্থ হত। তবে মেয়েলী বেশভূষা, পর্দা, নেকাবে সমাজকে ধোঁকা দিলেও এক ধরনের অপরাধবোধ ছিল। রাতে ঘরে ফিরে বিবেকের দংশনে বেশ কয়েকবার তওবা করেছিল মনে মনে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কাল থেকে আর কাজে যোগ দেব না। কিন্তু সকালে উঠে নানা হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখে হাম্মামে যেতেই হবে। রাতের তওবা ভেঙে পুনরায় হাম্মামে যায়।

বছরের পর বছর বিবেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কথা বুঝতে পারে নাসূহ। নফসের তাড়নায় বারবার পাপের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে উদ্ধারের পথ খোঁজে এখন। একদিন এক আল্লাহওয়ালার কাছে গিয়ে বলে, হুজুর! আমি একটি বিপদে পড়েছি। কইতেও পারি না। ছাড়তেও পারি না। আপনার খাস দোয়া চাই। আল্লাহর অলির তার মনের পুস্তিকা পড়ে জেনে যান রহস্য। মহান আল্লাহর একটি গুণ তিনি অতিশয় সহনশীল, বান্দার দোষখাতা গোপন করেন। সেই গুণের প্রভাবে আলোকিত ছিল আল্লাহর অলির হৃদয়। তাই তিনি ফাঁস করলেন না নাসূহের গোপন কথা। কারণ আল্লাহর মহব্বতের শরাব পিয়ে যাদের হৃদয় আলোকিত, তারা মানুষের গোপন কথা জানলেও প্রকাশ করেন না সহজে।

হারকে রা’ আসরারে কার আমূখতান্দ

মোহর কর্দন্দ ও দাহা’নশ দূখতান্দ

যাকে শিখানো হয়েছে নানা কাজের রহস্য

দেখবে মোহরাঙ্কিত তাদের মুখ সিলাইকৃত।

বুযুুর্গ মুখের কোলে হাসি দিয়ে বলল, নাসূহ! দোয়া করছি, আল্লাহ তোমাকে তওবা নসিব করুন। রাতে বুযুর্গ হাত তুলে দোয়া মাগেন নাসূহর হেদায়াত লাভের জন্য। সেই দোয়া সাত আসমান পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় আরশের মালিকের কাছে। আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কের সুবাদে এই দোয়া কবুল হতে বিলম্ব হয়নি। ফল হলো, আল্লাহতায়ালা একটি ওসিলা করে দিলেন, যাতে নাসূহ নিস্তার পায় ধ্বংসের গহ্বর হতে।

একদিন হাম্মামে এক বিপত্তি ঘটে। রাজকুমারীর মণিখচিত কানের দুলটি হারিয়ে যায়। মহিলারা তল্লাশি শুরু করে মূল্যবান রত্নটি খুঁজে পাওয়ার আশায়। ঝটপট হাম্মামের দরজা বন্ধ করা হলো। গোসল করতে আসা মহিলাদের জামা-কাপড় তন্নতন্ন করে দেখা হলো। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না অমূল্য রত্নের দুল। শ্বাসরুদ্ধ ঘুমোট পরিবেশ সর্বত্র। শুরু হলো দেহ তল্লাশি। একেক জনকে ডেকে বলা হয়, হা কর, কানের ভেতরে, নাকের ডগায় কিংবা শরীরের চিপায় লুকিয়ে রেখেছ কিনা দেখব। যাবে কোথায়? যুবা-বৃদ্ধ প্রত্যেককে উলঙ্গ করা হবে একেক করে।

সখিরা শুরু করল দেহ তল্লাশি। নাসূহর কলিজা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে জড়োসড়, আশ্রয় নিল নির্জন কোণায়। চেহারা হলুদাভ, লজ্জায় জবুথবু, এই বুঝি সামনে মৃত্যুর পরওয়ানা হাজির। নাসূহ নিরুপায়, অসহায়। আজ আল্লাহ ছাড়া কারো আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই।

গোফত ইয়া রব! বারহা’ বরগাশতে আম

তাওবাহা ও আহদাহা বেশ্কাস্তে আম

বলল, প্রভু হে! বারবার করেছি এই অপকর্ম

তওবার কথা ভুলে যত প্রতিজ্ঞা করেছি ভঙ্গ।

আমি পাপি, পাপের সাগরে নিমজ্জিত, পাপ আমার স্বভাবে পরিণত। এই পাপের অনুশোচনায় আজ আমার কলিজা পুড়ে ছাই। লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে আমার হৃদয়ের আঙিনাজুড়ে। অনুতাপের আগুন জ্বলছে আমার চোখে মুখে।

আমার মোনাজাতে দেখ কাবাব কলিজার গন্ধ আসে। দেহ-তল্লাশিতে এখনই যদি আমার পালা আসে, অবস্থা কী হবে। আজকের মতো দুশ্চিন্তা কোনো কাফেরের কপালেও যেন না জুটে।

প্রভু হে! আমি তোমার রহমতের আঁচলে আশ্রয় চাই। তোমার দয়ার একটুখানি পরশ দাও। যদি মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম না নিতাম। যদি কোনো নেকড়ের আক্রমণে প্রাণ দিতাম। প্রভু হে! তুমি অগতির গতি। আমি পাপী, পাপীর প্রতি তোমার মহান সত্তার যোগ্য ক্ষমার প্রকাশ চাই। চারদিক থেকে সাপবিচ্ছুর দংশনে আমার মস্তিষ্ক বিক্ষত। তুমি আজকের জন্য আমায় ক্ষমা কর, কথা দিলাম, ওয়াদা করছি, এই তওবা আর ভঙ্গ করব না। এই তওবার ব্যতিক্রম যদি কখনো করি, প্রভু হে! আমার কোনো দোয়া তুমি কবুল করবে না, কথা দিচ্ছি।

নাসূহর অশ্রুতে বুক ভেসে যাচ্ছিল, যেন তার সামনে আজরাইল হাজির। ডাক দেয়া হলো, সবার দেহ তল্লাশি শেষ। এবার নাসূহর পাল্লা। তখনই নাসূহ পড়ে গেল বেহুঁশ হয়ে ধপাস করে। যেন ভাঙ্গা দেয়াল পড়ে গেল মাটিতে। নাসূহর দেহের পিঞ্জর ছেড়ে রূহ উড়াল দিল ঊর্ধ্বলোকে। চোখের পলকে আল্লাহর সাথে সে রুহের মিলন হলো। বান্দা যখন নিজেকে ভুলে শুধু আল্লাহকে ডাকে, আল্লাহ তার প্রাণের পাখিকে আশ্রয় দেন আপন সন্নিধানে। সাধনার সাগরে অস্তিত্বের নৌকা যখন ভেঙে যায়, আল্লাহর রহমত এসে কুলে তোলে নেয় সে বান্দায়। নাসূহ আল্লাহকে ডেকে ডেকে বেহুশ হলো, ওদিকে রহমতের দরিয়ায় জোশ ও জোয়ার এলো। রহমতের দরিয়ার জোয়ারে পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হয় কান্নায় অশ্রুজলে। গ্রীষ্মের তাপদাহে যখন আল্লাহর রহমতের বরিষণ শুরু হয়, সবুজের সমারোহে চারদিক বনবীথিকায় রূপান্তরিত হয়।

হঠাৎ আওয়াজ উঠল, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। শাহজাদি নিজেই ওকোণায় রেখেছিল, পাওয়া গেছে। আনন্দে শোরগোলে হাত তালির আওয়াজে নাসূহর বেঁহুশি উধাও। সে যেন জেগে উঠল ঘুমের কোল ছেড়ে। তার চোখের চাহনীতে শত দিনের প্রখর কিরণের বিচ্ছুরণ। একে একে সবাই এসে ক্ষমা চায় নাসূহর কাছে। তোমাকে সন্দেহ করা বড় অন্যায় হয়েছে। মাফ করে দাও নাসূহ! আমাদের।

অনুসন্ধানীরা নাসূহর প্রতি সবচেয়ে বেশি সন্দিহান ছিল। কারণ সে ছিল শাহজাদির প্রিয়পাত্র। প্রথমেই তারা চেয়েছিল তাকে তল্লাশি করতে। কিন্তু শাহজাদির প্রিয়ভাজন হওয়ায় দেহতল্লাশি বিলম্ব করেছে।

নাসূহ অন্য সখিদের বলল, আল্লাহর খাস দয়া ছিল এই গুনাহগারের প্রতি। আমার সম্পর্কে তোমরা যা বলছ সে তুলনায় আমি অনেক অধম। তোমরা আমি গুনাহগারের কাছে কেন ক্ষমা চাও। আমি তো এ যুগের সবার চেয়ে নিকৃষ্ট। লোকেরা আমার সম্পর্কে কতটুকু কী জানবে। আমার হাজারো পাপ, মন্দ কাজের হয়ত একটিই মানুষ জানে। বাকি আমি জানি আর আমার প্রভু জানেন, যিনি তার সাত্তারিয়াত (বান্দার দোষপাপ গোপন রাখার) গুণে গুণান্বিত ।

আল্লাহ আমার দোষখাতা দেখার পরও গোপন করে রেখেছেন। মানুষের কাছে অপমানিত করেননি। তিনি আমার সব পাপ মোচন করে দিয়েছেন। দোযখের ভাগী ছিলাম বেহেশতের কাতারে এনেছেন। গোনাহের কারণে আমি আহাজারি করেছি। সেই আহাজারিকে আল্লাহ রশিতে পরিণত করেছেন। সেই রশি ফেলে দিলেন আল্লাহ আমার অস্তিত্বের গভীরে কামনার কূপে। সেই কূপ থেকে তিনি আমাকে তুলে এনেছেন রুহের প্রফুল্লতার ময়দানে।

গর সরে হার মূয়ে মন য়াবদ যবান

শোকরহায়ে তো নায়ায়দ দর বয়ান

আমার প্রতিটি লোমের যদি হয় একটি করে রসনা

তবু তোমার শোকর আদায় করে শেষ করা যাবে না।

কয়দিন গেলে হাম্মামে ডাক পড়ে, নাসূহ কেন আসে না। কিন্তু নাসূহ শাহজাদির ডাকুয়াকে সাফ বলে দেয় ওখানে আর যাব না। আমি অসুস্থ, হাতে ব্যথা, আমার হাত কাজ করছে না। শাহজাদিকে বলে দিও, যাতে অন্য কোনো চিন্তা করে। আমার পক্ষে আর কখনো যাওয়া সম্ভব হবে না।

তাওবায়ী করদাম হাকীকত বা’ খোদা

নাশ্কানাম তা জান শুদান আয তন জুদা

তওবা করেছি হাকীকি আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার

দেহ থেকে প্রাণ বেরুবার আগে ভাঙবো না আর।

মওলানা আরো বলেন, স্তন থেকে দুধ বের হবার পর দুধ পুনরায় স্তনে ঢুকে না, তেমনি খাঁটি অন্তরে তওবা করলে বান্দা সেই গোনাহে ফিরে যায় না। মনে আগ্রহ নিয়ে সেই গোনাহের কথা স্মরণও করে না। বরং দিনদিন সেই গোনাহের প্রতি তার ঘৃণা বাড়তে থাকে। গোনাহের প্রতি এই ঘৃণাবোধ প্রমাণ দেয়, বান্দার তওবা কবুল হয়েছে। যদি মন কৃত গোনাহের প্রতি পুনরায় আগ্রহ দেখায়, বুঝতে হবে যে, তার তওবা কবুল হয়নি, তাই। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,

‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকদের তওবা কবুল করবেন যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং সত্বর তওবা করে, এরাই সেই লোক, যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

তওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দ কাজ করে, অবশেষে তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে ‘আমি এখন তওবা করছি’ এবং তাদের জন্যও নয়, যাদের মৃত্যু হয় কাফের অবস্থায়। এরাই তারা, যাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।” (সুরা নিসা : ১৭- ১৮)।

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা করো- বিশুদ্ধ তওবা; আশা করা যায় যে, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দিবেন এবং তোমাদের দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত... (সুরা তাহরীম: ০৮)। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-২২২৮-২৩২৫)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন- ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত