এক ধোপার বাহন ছিল দুর্বল, ক্ষীণকায় গাধা। গাধা সকাল-বিকাল ধোলাই কাপড়ের বোঝা টানে। অথচ পেট ভরে খাবার পায় না। সারাদিন গতর খেটে কোমরটাও বেঁকে গেছে। পাথুরে জনপদে পানি ছাড়া তেমন কোনো খাবার জোটে না তার। দুঃখ-দুর্দশার এমন জীবন যেন গাধার ভাগ্যের লিখন। ধোলাই খালের অদূরে ছিল সবুজ বনানীর বনভূমি। সেখানে রাজত্ব করত এক সিংহ। একবার নর-হাতির সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে প্রচণ্ড আঘাতে ধরাশায়ী হয় সিংহ। ফলে সিংহ শিকার ধরতে পারে না জখমে জর্জরিত শরীর নিয়ে। দুপুর-সন্ধার খাবার দূরে থাক, সকালের নাস্তাও জোগাড় করতে পারে না অসহায়। তার খাওয়া-দাওয়ার পর বাদ বাকি উচ্ছিষ্ট খাবারে জীবন চালাত আশপাশের বেশকিছু প্রাণি। সিংহের দুরাবস্থায় ওসব পশুর পেটেও ক্ষুধার আগুন জ্বলছে।
পাড়ার শেয়াল মশাইকে ডেকে সিংহ বলল, ‘যাও তো, আমার হয়ে একটি গাধা শিকার করে আনো। কেন যেন শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছে না। কোথাও যদি একটা গাধা পাও, তোমার মন্ত্র দিয়ে পটিয়ে নিয়ে এসো আমার কাছে। গাধার গোশত খেয়ে আমার শরীরে শক্তি আসবে। তখন বনে একাই শিকার ধরতে পারব। আমি তো অল্প কতটুকু খাব। বাদ বাকি সব তোমরাই খাবে। গাধা না পেলে একটি গরু হলেও চলবে। তোমার তো অনেক মন্ত্র জানা আছে। ওখান থেকে দুয়েকটি পড়ে আকলবুদ্ধি গুম করে একেবারে আমার কাছে নিয়ে এসো।’
মসনবি শরিফে মওলানা রুমি (রহ.)-এর উদ্দেশ্য গল্প বলা নয়। নিজস্ব আধ্যাত্মিক জীবন দর্শন ব্যাখ্যার জন্য গল্পের কাঠামো মওলানার একটি কৌশল। এখানেও তিনি আমাদের নিয়ে যান আধ্যাত্মিক জগতের সিংহ শার্দুল ‘কুতুব’-এর পরিচয় ব্যাখ্যার বিশাল প্রান্তরে। তিনি বলেন-
কুত্ব শীর ও সেইদ কর্দন কা’রে উ
বাকীয়ান ইন খালক বাকীখা’রে উ
কুতুব হলেন সিংহসদৃশ, তার কাজ শিকার ধরা
তারই উচ্ছিষ্ট খেয়ে পালিত বাদ বাকি লোকেরা।
এ বয়েতের ব্যাখ্যায় মসনবি গবেষক করিম যামানি বলেন, মওলানা বলতে চান, কুতুব বা আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত অলি-আল্লাহ বা ইনসানে কামেল হলেন সৃষ্টির মাঝে আসমানি ফয়েজ বিতরণের পাওয়ার হাউজ। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ফয়েজপ্রাপ্ত হন আর তা মানুষের মাঝে বিতরণ করেন। এ কারণে আল্লাহওয়ালারা ‘কুতুব’কে মনে করেন ‘ওয়াসিতাতুল ফয়েজ’ বা ফয়েজ বিতরণের মাধ্যম। সৃষ্টির সবাই তাদের যোগ্যতা, প্রস্তুতি ও নৈকট্যের অনুপাতে সেই ফয়েজ থেকে লাভবান হয়। অন্য কথায়, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার দিক থেকে যে যত বেশি কুতুবের নিকটবর্তী হবে, সেই ফয়েজে তিনি তত বেশি উপকৃত হবেন। এ বিষয়টি বোঝানোর জন্য মওলানা নিজস্ব নিয়মে নানা উপমা ও গল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে তিনি কুতুবকে এমন সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন, যিনি আল্লাহর সাজানো বনভূমিতে আধ্যাত্মিক রহস্যজ্ঞানের শিকার ধরেন। এর দ্বারা তিনি নিজে লাভবান হন, বাদ বাকি যা থাকে, তা অন্যদের মাঝে বিতরণ করেন। প্রত্যেকে কুতুবের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা অনুপাতে সে ফয়েজ দ্বারা আলোকিত হন। সৃষ্টিলোকে কুতুবের ভূমিকা একদিকে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে গ্রহণকারী, আবার মানুষের মাঝে বিতরণকারী।
আধুনিক সভ্যতায় বিদ্যুতের বিষয়টি আমরা সামনে আনতে পারি। উৎপাদন কেন্দ্র হতে বিদ্যুৎ জমা হয় পাওয়ার হাউজে। সেখান থেকে সাপ্লাই হয় লোকালয়ে ঘরে ঘরে। যদি বলা হয়, বিদ্যুতের স্বরূপ কী? এর সঠিক জবাব আমরা দিতে পারব না। কাজেই ফয়েজের স্বরূপ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেয়া কী করে সম্ভব! বৈদ্যুতিক পাওয়ার হাউজের মতোই ‘কুতুব’-এর সঙ্গে যার সংযোগ যত ঘনিষ্ঠ ও মজবুত হবে, তিনি তত বেশি লাভবান হবেন, সহজ হিসাব।
মওলানা বলেছেন, তুমি যত পার নিঃস্বার্থভাবে কুতুবের খেদমত করো, তার মনে কষ্ট দিও না। তাহলে বাকি লোকেরা বঞ্চিত হবে। কারণ, মানুষের মনে যে আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও আল্লাহর ভালোবাসার স্ফুরণ ঘটে, তা কুতুবের উচ্ছিষ্টস্বরূপ। কুতুবের পাওয়ার হাউজ থেকে সঞ্চারিত ফয়েজ। সৃষ্টিলোকে কুতুবের অবস্থান ও ভূমিকা মানবদেহে আকল বা জ্ঞানবুদ্ধি ও মস্তিষ্কের ভূমিকার মতো। অন্য লোকদের উপমা দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ন্যায়। দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালিত হয় মস্তিষ্কের নির্দেশ ও ইচ্ছাশক্তির ইশারায়। কুতুবের পরিচয় ব্যক্ত করে মওলানা বলেন-
কুতুব অন বা’শদ কে গের্দে খোদ তানাদ
গর্দেশে আফলাক গের্দে উ বুয়াদ
কুতুব, সে ঘুর্ণনরত আপন সত্তাকে কেন্দ্র করে
আকাশের ঘুর্ণন কুতুবকে মাঝখানে রেখে।
করিম যামানি নিকলসনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কুতুবের নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। তিনি আল্লাহতে ফানি ও বিলীন। আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টিতে তিনি সন্তুষ্ট। আল্লাহর ধ্যান-জ্ঞান ছাড়া তিনি আর কিছু বোঝেন না। ক্ষণস্থায়ী সবকিছু থেকে মন ফিরিয়ে নিবদ্ধ করেছেন আল্লাহর দিকে। সূর্য আল্লাহর সৃষ্টি, পৃথিবীতে উত্তাপ ছড়ায়, আলো বিলায়। তার মানে আলো উত্তাপ ও প্রাণশক্তি সঞ্চালনের মাধ্যম সূর্য। কুতুব যদি এ ধরনের কোনো আধ্যাত্মিক দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করেন, অবাক হওয়ার কী আছে! আপন সত্তাকে কেন্দ্র করে ঘুর্ণনের মাহাত্ম্য বোঝার জন্য আল্লামা ইকবালের একটি উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য-
কম খোর ও কম খাব ও কম গোফতার বা’শ
গের্দে খোদ গার্দান্দে চোন পরগা’র বা’শ
কম খাও, কম ঘুমাও, কম বলার লোক হও
কম্পাসের মতো নিজের কেন্দ্রে ঘুর্ণনরত হয়ে যাও। (জাভেদনামা)।
ইকবালেরও পরামর্শ এমন কুতুবের সাক্ষাত যদি পাও, তার সামনে নিজেকে সঁপে দাও। তাকে সাহায্য করলে তার কিছু বৃদ্ধি হবে না। বরং তাতে তুমিই ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ হবে।
য়ারিয়ত দর তো ফযায়দ না আন্দরু
গোফত হক ইন তানসুরুল্লাহ তুনসারু
তাকে সাহায্য বর্ধিত করবে তোমার, নয় তার
আল্লাহকে সাহায্য করো, তবেই সাহায্য পাবে তার।
কোরআন মাজিদের নিম্নোক্ত আয়াত থেকে দলিল এনেছেন এ বয়েতে। যমখশারি বলেন, ‘আল্লাহকে সাহায্য মানে আল্লাহর দ্বীন ও নবীকে সাহায্য করা।’ নবীজির অবর্তমানে যারা আল্লাহর দীনের জন্য জীবনোৎসর্গ করেছেন, তাদের সাহায্য করাই হবে আল্লাহকে সাহায্য করার প্রতিপাদ্য। আয়াত হলো- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন। আর তোমাদের পদক্ষেপকে সুদৃঢ় করবেন।’ (সুরা মুহাম্মদ : ৭)।
মওলানার উপদেশ, শেয়াল যেভাবে সিংহের কাছে শিকার ধরে আনে, তুমিও লোকদের আল্লাহর অলিদের কাছে নিয়ে এসো। কেননা, তাদের সাহচর্যে মুর্দা দিল জিন্দা হয়ে যায়। অপবিত্র জিনিস পবিত্র হয়। দুনিয়ার ধন-সম্পদ অপবিত্রতার প্রতীক। আল্লাহর অলিরা দুনিয়াবি সম্পদকে আল্লাহর দ্বীনের পথে খরচ করার প্রেরণা দেন, পথ দেখান। দুনিয়া নিয়ে যারা বুঁদ হয়ে আছে, আল্লাহর মহব্বতের ছোঁয়া পেয়ে তাদের হৃদয় জাগ্রত হয়।
গল্পের ধারাবাহিকতায় ফিরে এসে মওলানা বলেন, শেয়াল বলল, ‘জাহাঁপনা! আপনার আদেশ শিরোধার্য। নানা মন্ত্রে কৌশলে আমি গাধার জ্ঞানবুদ্ধি হরণ করে নিয়ে আসব আপনার কাছে।’ মসনবির গল্পের বৈশিষ্ট্য হলো, গল্পের চরিত্র সব সময় এক রকম থাকে না। কোনো চরিত্র কখনও প্রশংসনীয়, কখনও নিন্দনীয় হয়ে যায়। যেমন- এ পর্যন্ত সিংহ চরিত্র ছিল কুতুবের প্রতীক আর শিয়ালের চরিত্র ছিল নিবেদিতপ্রাণ মুরিদের। এখন থেকে শেয়ালের চরিত্র পাল্টে যাবে। শেয়াল এখন ধোঁকাণ্ডপ্রতারণার প্রতীক। গল্পের চরিত্রের ভূমিকায় এ পরিবর্তন প্রমাণ করে, মসনবিতে গল্প বলা বা গল্পের উপসংহার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা মওলানার উদ্দেশ্য নয়; বরং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আধ্যাত্মিক তত্ত্বরহস্য ব্যক্ত করা ও নৈতিক শিক্ষার সৌধ রচনা করাই আসল উদ্দেশ্য।
শেয়াল বলল, ‘ধোঁকা দেয়া, মন্ত্রপাঠে আকলজ্ঞান হরণ করাই আমার কাজ।’ বনভূমি থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে, দূরে দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছে এক গাধা। কাছে গিয়ে সালাম জানিয়ে বলল, ‘কেমন আছেন, একাকী এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। মন খারাপ বুঝি? শরীর-স্বাস্থ্যও দেখছি নাজেহাল অবস্থা।’ গাধা বলল, ‘হ্যাঁ ঠিকই। তবে জীবনটা দুঃখে-কষ্টে একভাবে গোজরান হচ্ছে। এরপরও ভালো আছি। আমার কিসমত তো এমনই। যেভাবে রেখেছেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে হাজারো শোকর।’
শোকর গুয়াম দূস্ত রা দর খাইরো শার
যাঙ্কে হাস্ত আন্দর কাযা আয বদ বাতার
শোকর জানাই প্রিয়তমের, ভালো মন্দ সর্বাবস্থায়
কারণ, মন্দের চেয়েও মন্দ থাকতে পারে ভাগ্য লেখায়।
আমি ভালো থাকি বা মন্দ সর্বাবস্থায় প্রিয়তম আল্লাহর দরবারে হাজারো শোকর। কেননা, এখন যে মন্দ অবস্থায় আছি, তাকদিরের ফয়সালায় এর চেয়েও মন্দ হওয়া অসম্ভব নয়।
চোনকে কাসসাম উস্ত কুফর আমদ গেলেহ
সবর বা’য়দ সবর মিফতাহুস সেলেহ
ভাগ্যের বিধাতা যেহেতু তিনি, আপত্তি করলে কুফরি হবে
সবর করতে হবে, সবরে মেওয়া ফলে, যায় চাবি খুলে।
সবর, ধৈর্য বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট নেয়ামত। কোরআন মাজিদের অসংখ্য আয়াতে আছে, আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে আছেন। সবরের মাহাত্ম্য বোঝা যায় যুন্নুন মিসরির উক্তি থেকে। তিনি বলেন, আমি এক রোগীকে দেখতে গেলাম। তিনি তখন কাঁদছিলেন। তাকে বললাম, ‘মহান রবের মারধরে যে সবর করে না, মহান রবের সঙ্গে বন্ধুত্বের দাবি তার সত্য হতে পারে না।’ তিনি আমার কথার জবাবে বললেন, ‘কথাটি এভাবে বললেই উত্তম হতো, আল্লাহর পক্ষ থেকে মারধরের শিকার হয়ে যে স্বাদ অনুভব করে না, মজা পায় না, আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্বের দাবিতে সে সত্যবাদী নয়।’ বস্তুত মানুষের জীবনে যে বিপদণ্ডমসিবত আসে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মানুষ আল্লাহর দয়াদান নেয়ামত ধারণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
গাইরে হক জুমলা আদু আন্দ উস্ত দোস্ত
বা আদু আয দোস্ত শেকওয়াত কেউ নেকূস্ত
আল্লাহ ছাড়া সবই শত্রু, আর যত কিছু আছে
শত্রুর কাছে বন্ধুর শেকায়াত কীভাবে সাজে!
বিপদণ্ডমসিবতে মানুষের কাছে হা-হুতাশ করা, অধৈর্য হয়ে চিৎকার-চেচামেচি করা মূলত আল্লাহর বিরুদ্ধে শেকায়াতের মতো। আল্লাই তো মানুষের পরম বন্ধু।
আল্লাহকে বাদ দিয়ে যত কিছুর আশ্রয় চাওয়া হবে, সব শত্রু। কাজেই শত্রুর কাছে বন্ধুর বিরুদ্ধে নালিশ করা সাজে না। এ দুনিয়া আপেক্ষিকতার জগত। এখানে একটি পেলে আরেকটি হাতছাড়া হয়ে যায়। সম্পদহীন তাই দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সম্পদ পাওয়ার পর তা রক্ষার দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে যায়। কাজেই আল্লাহ যে অবস্থায় রেখেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই জীবনের সুখ ও শান্তি।
(মসনবি শরিফ : ৫ম খণ্ড, বয়েত : ২৩২৬-২৩৬০)
[ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১ ১১৫ ৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন :
- CHAYAPATH PROKASHONI]