প্রথম অহি নাজিলের পর নবীজি (সা.) যখন কম্পিত দেহে বাড়ি এসে বলেন, ‘আমাকে চাদরে ঢেকে দাও। আমার জীবন সম্পর্কে ভয় হচ্ছে।’ সত্যিই তখন এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন জ্ঞানী, বিচক্ষণ, বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী আমাদের মা খাদিজা (রা.) স্বামীর জীবনের এমন চরম মুহূর্তে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। তার প্রথম দায়িত্ব স্বামীর বিচলিত মনকে শান্ত করা। তিনি দেখেছেন আজীবন তার স্বামী সত্য ও সুন্দরকে লালন করেছেন। কাজেই তার জীবন কখনও বিপত্তির মুখে পড়তে পারে না। তিনি নিশ্চিত। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘আপনি আনন্দিত হোন। সুসংবাদ আপনার জন্য। আমি তো আশা করি, আপনি হবেন এ জগতের জন্য আল্লাহর বার্তাবাহক পয়গম্বর। আপনি হবেন শেষ জমানার নবী।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/২১০)। এ সান্ত¦নাবাণীর পক্ষে খাদিজা (রা.) যুক্তি দেখিয়ে বললেন, ‘কখনও না, ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনোই আপনাকে অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি নিজ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। দুর্বল ও দুস্থ লোকদের সেবা করেন। বঞ্চিত ও অভাবীদের উর্পাজনক্ষম করেন। মেহমানদের আতিথেয়তা করেন। বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করেন।’ (বোখারি : ৩)।
ওয়ারাকা ইবনে নাওফলের কাছে গমন : খাদিজা (রা.) এভাবে স্বামীকে সান্ত¦না দেন। উদ্বেগ প্রশমনের ব্যবস্থা করেন। আস্তে আস্তে আল্লাহর নবী ঘুমিয়ে পড়েন। নবীজিকে সান্ত¦না দিলেও বিবি খাদিজার মন ছিল অস্থির। তিনি যে স্বামীকে চেনেন, তার জীবনে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন সেই কবে থেকে। তিনি ভাবেন, আমার স্বামী তো জীবনে কখনও অযথা কোনো কথা বলেননি। এখন যে ঘটনার কথা বললেন, তা তো অস্বাভাবিক। তা অমঙ্গলজনক কিছু হতে পারে না। এ কথায় পুরোপুরি আস্থা থাকলেও মনের অস্থিরতা কাটছে না। আগন্তুক ফেরেশতা সত্যিই আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছেন কি না, জানতে বড় ইচ্ছে তার। তাই তখনকার সমাজের একজন ধর্মীয় বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। খাদিজা (রা.) নবীজিকে সঙ্গে নিয়ে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জার কাছে গেলেন। ওয়ারাকা জাহেলি যুগে ঈসায়ি ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরাণি ভাষায় কিতাব লিখতেন। তাই আল্লাহর ইচ্ছা ও তৌফিক অনুযায়ী তিনি ইঞ্জিলের অনেকাংশ (সুরিয়ানি ভাষা থেকে) ইবরাণি ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদিজা (রা.) তাকে তার ভাতিজা অর্থাৎ রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে সব কথা শুনতে বললেন। ওয়ারাকা তার ভাতিজার বক্তব্য শুনতে চাইলেন। রাসুল (সা.) তাকে তার সব ঘটনা শোনালেন।
ওয়ারাকার দরদমাখা ভবিষ্যদ্বাণী : পুরো বিবরণ শুনে ওয়ারাকা নবীজিকে বললেন, ‘এ সেই রহস্যময় জিবরাইল ফেরেশতা, যাকে মুসা (আ.)-এর কাছে আল্লাহ নাজিল করেন। হায়! আমি যদি তোমার নবুওয়তের সময় বলবান যুবক থাকতাম। হায়! আমি যদি সে সময় জীবিত থাকতাম, যখন তোমার জাতি তোমাকে মক্কা থেকে বের করে দেবে।’ রাসুল (সা) ওয়ারাকাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা কি সত্যিই আমাকে বের করে দেবে?’ ওয়ারাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে (দুনিয়ায়) এসেছ, তদ্রুপ কোনো কিছু নিয়ে যে ব্যক্তিই এসেছে, তার সঙ্গে শত্রুতা করা হয়েছে। আমি তোমার যুগে বেঁচে থাকলে তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব।’ তারপর ওয়ারাকা ইন্তেকাল করলেন এবং অহিও (তিন বছর পর্যন্ত) স্থগিত রইল। (বোখারি : ৩)।
ওয়ারাকার আরো পরামর্শ : সিরাতে ইবনে হিশামে ঘটনার বর্ণনা অন্যভাবে দেয়া হয়েছে। সে বর্ণনায় ওরাকা ইবনে নাওফালের কাছে বিবি খাদিজা (রা.) একাকী গিয়েছিলেন। ইবনে হিশামের বর্ণনা এরূপ- ‘এ কথা বলার পর (নবীজিকে সান্ত¦না দেওয়ার পর) খাদিজা (রা.) উঠে চললেন। মাথায় চাদর টেনে নিলেন। মক্কায় প্রবেশ করলেন। তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফালের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। ইঞ্জিল ও তাওরাতের জ্ঞান অর্জনে কষ্টকর সাধনা করেছিলেন। আমাদের নবী (সা.)-এর অবস্থা ভালোভাবে জানতেন। খাদিজা (রা.) তার কাছে নবীজি (সা.)-এর কথা তুলে ধরলেন। তিনি যা যা দেখেছেন, শুনেছেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। খাদিজা (রা.)-এর কাছ থেকে বিবরণ শোনার পরপরই ওয়ারাকা বলে উঠলেন, ‘পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র সেই সত্তা! যার কুদরত ও হেকমতের মধ্যে এমন বিস্ময়কর রহস্য নিহিত।’ এরপর বললেন, ‘হে খাদিজা! তুমি যা বলেছ, তা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে জেনে রেখ যে, তিনিই বড় নামুস (জিবরাইল) আল্লাহর পক্ষ হতে তার কাছে এসেছেন, যিনি মুসা (আ.)-এর কাছে আসতেন। তিনি তার কাছ থেকে যা শুনেছেন, তা আল্লাহর অহি। আর মুহাম্মদ হলেন শেষ জমানার পয়গম্বর। তাকে বলবে, যেন সন্তুষ্ট মনে থাকে। আর তার সামনে যে অবস্থা প্রকাশ হয়েছে, তার ওপর অবিচল থাকে। মনে যেন কোনো দুশ্চিন্তার প্রশ্রয় না দেয়।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/২১০)।
খাদিজা (রা.) ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল যা কিছু বললেন, নবীজির কাছে গিয়ে বললেন। ইবনে হিশাম আরও বলেন, নবীজি (সা.) অহি নাজিল হওয়ার পর বাকি দিনগুলো অর্থাৎ পুরো রমজান মাস হেরা গুহায় ছিলেন। রমজান শেষ হলে তিনি সেখান থেকে পুনরায় মক্কায় চলে আসেন। প্রথমে তার আগের নিয়মানুযায়ী কাবাঘরের তওয়াফ করতে যান। তিনি যখন কাবাঘরের তওয়াফ করছিলেন, তখন ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল তাকে দেখতে পান। ওয়ারাকা বললেন, ‘ভাতিজা! আমাকে বল তো- তুমি কী দেখেছ, কী শুনেছ?’ তখন নবীজি (সা.) তাকে সবকিছু খুলে বললেন। ওয়ারাকা তখন শপথ করে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! সেই সত্তার শপথ, যার কুদরতের হাতে আমার প্রাণ, তুমি যাকে দেখেছ, তিনি নামুসে আকবার (জিবরাইল)। তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে মুসা (আ.)-এর কাছে আসতেন। তিনিই তোমার কাছে এসেছেন। তার কাছ থেকে তুমি যা শুনেছ, তা আল্লাহর অহি। তুমি শেষ জমানার পয়গম্বর এবং জগদ্বাসীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। জেনে রেখ যে, তুমি যখন নবুওয়তের দাবি করবে এবং মানুষকে সেদিকে আহ্বান জানানো শুরু করবে, তখন তোমার জাতি তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। তোমার ওপর নিপীড়ন করবে। তোমাকে মক্কা থেকে বের করে দেবে। সৈন্য চালনা করবে। তোমার সঙ্গে লড়াই করতে আসবে। তোমার জাতি যখন তোমার সঙ্গে এমন আচরণ করবে, যদি সে সময় আমি বেঁচে থাকি, তাহলে আমার শক্তি ও সামর্থ্য যা থাকে, তা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করব। তোমার কাজকে শক্তিশালী করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করব। কিন্তু কী করব! আমি যে বুড়ো হয়ে গেছি। সেই সময়ের ব্যাপারে আশঙ্কা করছি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/২১০)।
ইবনে হিশাম আরো বলেন, ওয়ারাকা কথাগুলো বললেন। রাসুল (সা.) তওয়াফ শেষ করে বাড়ি ফিরে গেলেন। তখন নিয়মমাফিক জিবরাইল (আ.) আগমন করলেন। নবীজি (সা.) তাকে দেখলেন। তার কথা শুনলেন। কিন্তু তার মনে তখনও দৃঢ় প্রত্যয় হচ্ছিল না যে, আগন্তুক ব্যক্তি জিবরাইল। তার মনে তখন অন্য চিন্তা এলো।
তিনি নিজের এ অবস্থার কথা খাদিজা (রা.) ছাড়া আর কারও কাছে বলছিলেন না। একদিন তিনি ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। তখন খাদিজা (রা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি নিজের এ অবস্থা সম্পর্কে ভয় পাচ্ছি। জানি না, আমি যাকে দেখছি, তিনি কে? আর তার কাছ থেকে যা শুনতে পাই, তা কী?’