ঢাকা ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২২৪)

জীবন সংগ্রাম বনাম নিয়তির বিধান

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
জীবন সংগ্রাম বনাম নিয়তির বিধান

গ রিব লোকটির পেশা ছিল পানি বহন। ঘরে-বাড়িতে পানি সরবরাহ করে দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে তার জান বেরিয়ে যেত। পানি বহনের গাধাটিরও ছিল জীর্ণ দশা। একদিন সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল রাজবাড়ির ঘোড়াশালের প্রধান অশ্বচালক। গরিব মানুষের দুরাবস্থা দেখে তার অন্তরে মায়া হলো। অশ্বের লাগাম টেনে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে ভাই! আপনার গাধার এ অবস্থা কেন? কেমন আছেন আপনি?’ গরিব লোকটি বলল-

গোফত আয দারবেশি ও তাকসিরে মন

কে নেমি য়া’বদ খোর্দ ইন বস্তে দাহান

বলল- আমার দারিদ্র দুর্বলতার কারণে

অবুঝ পশুটিও খেতে পায় না পেট ভরে।

অশ্বচালক প্রস্তাব দিল, আমি আপনার একটি উপকার করতে পারি, যদি আপনি রাজি থাকেন। আপনি ক’টা দিন আপনার গাধাটি আমার দায়িত্বে ছেড়ে দেন। রাজার আস্তাবলের অশ্বগুলোর উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো খেলেও এ গাধা দেখবেন মোটাতাজা হয়ে গেছে। প্রস্তাব শুনে গরিব লোকটির চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক ভেসে উঠল। সানন্দে সে গাধাটি দিয়ে এলো সুলতানের আস্তাবলে। নতুন পরিবেশে গিয়ে গাধার চোখ ছানাবড়া। যেদিকে তাকায়, সুঠাম সবল দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া আর ঘোড়া! আস্তাবলের নিচে কোথাও আবর্জনার চিহ্ণ নেই। ঝাড়ু দেয়ার পর পানিতে ধোয়া-মোছার কাজ হয় যথারীতি। কী চমৎকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ! নির্দিষ্ট সময়ে ঘোড়ার পিঠ মালিশ করা হয়। যত্নআত্তির কমতি নেই। খাবারও আসে পর্যাপ্ত নির্দিষ্ট সময়ে। নাদুস-নুদুস শরীর তাদের চকচক করে। অবস্থা দেখে গাধা আকাশের দিকে মুখ তুলে সরাসরি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে-

না কে মাখলুকে তো আম গীরম খরম

আয ছে যার ও পোশত রীশ ও লাগরম

রব হে! আমি না তোমার সৃষ্টি যদিও হই গাধা

কী কারণে আমার কপালে এত দুর্গতি দৈন্যদশা?

আমি গাধা হতে পারি; কিন্তু তোমার সৃষ্টি তো। আমাকে এমন দুরাবস্থার মধ্যে তুমি রেখেছ। রাত এলে কোমরের ব্যথায় ঘুম আসে না। ক্ষুধার্ত পেটের যন্ত্রণা সওয়া যায় না। প্রতি রাতে ভাবি, এ অবস্থার চেয়ে মৃত্যুই তো ভালো ছিল। অথচ এ ঘোড়াগুলো কত নাদুস-নুদুস, চকচকে রঙ, সুঠাম সবল। আর আমি দুঃখ-কষ্টের ঘানি টানি সারা জনম। সুলতানের আস্তাবলে গাধার মনে এসব কথা উঁকিঝুঁকি দেয়। নানা চিন্তায় মনটা একেকবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। একদিন গাধা এসব চিন্তা নিয়ে বেশ মনোকষ্টে ভুগছিল, এমন সময় শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের সংবাদ এলো। অশ্বচালকরা তড়িঘড়ি জিন পরিয়ে অশ্বগুলো প্রস্তুত করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবগুলো বীরদর্পে ছুটে গেল রণাঙ্গনে। আস্তাবলে সারাদিন একা গাধা। সন্ধ্যা নাগাদ অশ্বগুলোর সাক্ষাত পেল। দেখল, এলোপাতাড়ি তীর খাওয়া আহত কয়েকটি অশ্ব কেবল খোঁড়ায়। আস্তাবলের পশুচিকিৎসকরা তৎপর হয়ে ওঠে। অশ্বের শরীর থেকে তীরের ফলা বের করা আর চামড়া সিলাইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তীরের আস্ত ফলা টানতেই দরদর করে রক্ত বেরিয়ে আসে। অবস্থা দেখে গাধা চমকে ওঠে-

অ’ন খর অ’ন রা দীদ ও মী গোফত আই খোদা

মন বে ফকরো আফিয়াত দা’দম রেযা

সেই গাধা অবস্থা দেখছিল ও বলছিল আল্লাহকে ডেকে

আমি সন্তুষ্ট দারিদ্রে ও নিরুপদ্রব জীবন নিয়ে।

আমি চাই না সুলতানের আস্তাবলের অশ্বগুলোর নাদুস-নুদুস শরীর। চাই না তাদের বসে বসে খাওয়ার বিশেষ সুবিধা। সাময়িক সুখের পর এমন দুর্গতি, জীবনের ঝুঁকির চেয়ে আমার অভাবের জীবন অনেক উত্তম। আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরের ওপর সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই মানসিক শান্তি ও জীবনের সুখ। কেউ যেন মনে না করে, জীবনের আরামণ্ডআয়েশ ও দুনিয়াবি সুখভোগের মধ্যেই প্রকৃত শান্তি; বরং বিপদণ্ডমসিবত যে কারও জন্য ওঁতপেতে থাকে। ধৈর্যের সঙ্গে বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা এবং চেষ্টার পর প্রাপ্ত তাকদিরের ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা চাই।

গত সপ্তাহে আলোচিত অসমাপ্ত গল্পের ধারাভাষ্যে বিরতি দিয়ে মওলানা রুমি (রহ.) উপরিউক্ত গল্পের অবতারণা করেন। আমরা এখন আগের গল্পের দৃশ্যপটগুলো খুলে দেখব- ধোপার জীর্ণশীর্ণ গাধার যুক্তি ছিল, আমি যে অবস্থায় আছি, ভালোই আছি। জীবন-জীবিকার জন্য জানকান্দানি করব না। এ কাজ তাওয়াক্কুলের বরখেলাফ। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে থাকব। শিয়াল তাকে বলল, হালাল রিজিক তালাশ করা প্রত্যেক মোমিনের ওপর ফরজ। হাদিস শরিফে আছে, হালাল রিজিক তালাশ করা অন্য ফরজ ইবাদতের পর আবশ্যক ফরজ। শিয়াল যুুক্তি দিয়ে বোঝাল, এ জগত কার্যকরণের জগত। এখানে কারণ ছাড়া কোনো কিছু হয় না। উসিলা-মাধ্যম অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কারণ ছাড়া, চেষ্টা-তদবির ছাড়া কিছুই তোমার হস্তগত হবে না-

ওয়াবতাগু মিন ফাযলে আল্লাহ আস্ত আমর

তা’ নবা’য়দ গসব কর্দন হামচো নাম্র

আদেশ হলো, আল্লাহর দয়া ও ফজল সন্ধান কর

যাতে নেকড়ের মতো হামলে পড়ে গ্রাস না কর।

চেষ্টা-সাধনা পরিশ্রম না করলে বাধ্য হয়ে অবৈধ রাস্তা অবলম্বন করতে হবে। নেকড়ের মতো জোরজুলুমের পথ বেছে নিতে হবে। কাজেই চেষ্টা ও পরিশ্রমের পথই সত্যিকার পথ। এ বয়েতে মওলানা কোরআনের একটি আয়াতের ভাবার্থ ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(জুমার দিন) নামাজ যখন আদায় হয়ে যায়, তখন তোমরা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহসমূহ হতে সন্ধান কর। আর আল্লাহকে স্মরণ কর। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।’ (সুরা জুমা : ১০)। কাজেই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের দোহাই দিয়ে অকর্মন্য হয়ে বসে না থাকার সুযোগ নেই। রিজিকের সন্ধান করা, চেষ্টা পরিশ্রম করা আল্লাহরই নির্দেশ। হাদিসে বিষয়টি আরো সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে-

গোফত পয়গাম্বর কে বর রিযক আই ফতা’

দর ফরো বস্ত আস্তো বর দর কুফলহা’

নবীজি (সা.) বলেন, রিজিকের ওপর হে তরুণ!

দরজা বন্ধ তালা লাগানো আছে তার ওপর।

জুম্বিশ ও আ’মদ শুদে মা ও ইকতেসাব

হাস্ত মিফতাহী বর অ’ন কুফলো হিজাব

আমাদের তৎপরতা, আসা-যাওয়া, আয়-উপার্জন

সেই বদ্ধ দুয়ার ও তালা খোলার চাবির মতো।

বী কলীদ ইন দর গুশাদন রাহ নীস্ত

বী তলব নান সুন্নাতে আল্লাহ নীস্ত

চাবি ছাড়া এ দরজা খোলার কোনো উপায় নেই

সন্ধান বিনে রুটি-রুজি আল্লাহর বিধানে নেই।

শিয়ালের এমন জোরালো ভাষণ শোনার পরও গাধা অনড়। বলল-

গোফত আয যা‘ফে তাওয়াক্কুল বা’শদ আ’ন

ওয়ার না বেদ্হাদ না’ন কেসী কে দা’দ জা’ন

বলল, আল্লাহতে ভরসার দুর্বলতায় বলছ এসব কথা

প্রাণ যিনি দিলেন রুজিও তিনি দেবেন, নয় অন্যথা।

তাওয়াক্কুল মানে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। সুফি দর্শনে তাওয়াক্কুল একটি প্রধান মূলনীতি। যে কোনো কাজে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা দ্বীন-ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু এ শিক্ষার অপপ্রয়োগের ফলে একশ্রেণির মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানদারি ছেড়ে আল্লাহর পথে বেরিয়ে যাওয়ার বিকৃত বিশ্বাস বর্তমান সমাজেও বিস্তার লাভ করেছে। তাওয়াক্কুলের আসল ভাবধারা হলো, কাজ করা, চেষ্টা-সাধনায় নিয়োজিত থাকা; তবে কাজ ও চেষ্টাই সাফল্যের জন্য যথেষ্ট- এ কথা মনে না করা। চেষ্টার ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করা, সুফল আসুক বা না আসুক তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকদিরের ফয়সালা মনে করে সন্তুষ্ট থাকার নাম রেজা (সন্তুষ্টি)-এর মাকাম।

তাওয়াক্কুলের ফজিলত বর্ণনা প্রসঙ্গে মওলানা (রহ.) বলেন, আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য যারা চেষ্টা করে, জীবন-জীবিকায় তারা একেবারে পিছিয়ে থাকে না। আল্লাহতায়ালাই তো বলেছেন, ‘যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে চলে, তার জন্য আল্লাহ কোনো পথ করে দেন। এমন উৎস থেকে তাকে রিজিক দান করবেন, যে সম্পর্কে সে ধারণাও করেনি।’ (সুরা তালাক : ২-৩)। পশুপাখি, বন্যপ্রাণীরাও রিজিক পায়। এদের চাষবাস নেই, রোজ চাকরিতে যায় না। আগামীকালের চিন্তা নেই। এরপরও এদের জীবন থেমে নেই। এমন কতক জীবজন্তু আছে, যারা নিজেদের জন্য খাদ্য মজুদ রাখে না। আল্লাহই রিজিক দান করেন তাদের ও তোমাদের। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আনকাবুত : ৬০)।

গাধার পরিষ্কার কথা, যে সবর করে, তার কাছে রিজিক আসবেই। মানুষ যে চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রম করে, তার মূলে রয়েছে তাদের ধৈর্যের অভাব। শিয়াল বলল, তোমার কথা ঠিক আছে। তাওয়াক্কুল অত্যন্ত উঁচু মাকাম; কিন্তু এ মাকামে পৌঁছা যার তার কাজ নয়। রাজত্ব মানুষই করে। কিন্তু সবাই কী রাজা হতে পারে! হাতেগোনা ক’জনের ভাগ্যে রাজত্ব জোটে! দুয়েকটি ব্যতিক্রম ঘটনাকে সর্বজনীন নিয়ম গণ্য করে সিদ্ধান্ত নেয়া ভুল। কাজেই তাওয়াক্কুলের উচ্চ মাকামের কথা বলে নিজেকে অকর্মণ্য করে রাখা উচিত হবে না।

গাধা বলল, তুমি যে সবকিছুকে উল্টো ব্যাখ্যা করছ, তা তোমার লোভের কারণে। দেখ, অল্পেতুষ্টি অবলম্বন করে কেউ মারা পড়েনি কিংবা লোভের পিঠে সওয়ার হয়ে কেউ রাজত্ব লাভ করতে পারেনি। কাজেই চেষ্টা দিয়ে কিছু হবে না। তাওয়াক্কুল কর, সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ : ৫ম খণ্ড, বয়েত ২৩৬১-২৪০০)।

(ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১ ১১৫ ৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত