ঢাকা ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রকৃত মানুষের পরিচয়

দিদার শফিক
প্রকৃত মানুষের পরিচয়

জীবন কিছু নির্দিষ্ট সময়ের সমষ্টি। জীবনের এ নির্দিষ্ট সময়গুলো যেভাবে কাটানো হয়, এর ওপর ভিত্তি করে মানুষের চরিত্র ও স্বরূপ নির্ণিত হয়। তাই বলা চলে, স্বভাব ও চরিত্রগুণেই মানুষের পরিচয়। রক্তে-মাংসে গড়া সুঠাম দেহের অধিকারী হলেই কাউকে মানুষ বলা যায় না কিংবা কেউ অর্থ-প্রাচুর্যে বা জাগতিক কাজকর্মে সবাইকে ছাড়িয়ে অনন্য স্থান দখল করে শীর্ষদের কাতারে শামিল হলে, তাকেও বিনাবাক্যে মানুষ বলা যায় না। ধন-সম্পদ, পদপদবি ও কারিগরিবিদ্যা জাগতিক প্রয়োজনমাত্র। এগুলো চলার পথের উপকরণ, সরাসরি মানুষ হওয়ার উপকরণ নয়। তবে জাগতিক অভিজ্ঞতায় মানুষ পারিপার্শিক বিষয়ে পরিপক্ব হয়। এ পরিপক্বতার সঙ্গে মনুষ্যত্বের সংযোগ হলে, তখন মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে। এ মানুষ হওয়াটাই তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতার মূল শিক্ষা।

আজকাল মানুষ উচ্চ শিক্ষিত হয়, কিন্তু উচ্চ স্তরের মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে না। প্রচুর সম্পদের মালিক হতে প্রতিযোগিতা করে, কিন্তু সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম বাছবিচার করে না। সরলতা ও ক্ষমা সুন্দর আচরণকে দুর্বলতা ভেবে অনেকে মনের অজান্তেই জালেম হয়ে ওঠে। এসব আচরণগত ত্রুটিকে আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বলা হয়। নৈতিক অবক্ষয় রোধ করে চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের নিরন্তর প্রয়াস সুফিসাধকদের প্রাথমিক গুণ। এসব গুণ সব শ্রেণির মানুষের থাকা প্রয়োজন। অন্তত এ চেতনা প্রতিটি মানুষের থাকা চাই ‘পারলে অন্যের উপকার করব, কিন্তু কখনোই কারও ক্ষতি করব না’। এ মানসিকতা অনেক পাপ থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। মনুষ্যত্ব বিকাশে সহায়ক হয়।

হাল-যমানার হালচাল : আফসোসের বিষয় হলো, হালে মানুষ অন্যকে ঠকিয়ে কিংবা ঠেকিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করাকে পেশাদারিত্বের অংশ মনে করছে। যা মূলত অনৈতিকতা, মূর্খতা ও নিতান্তই ঘৃণিত কাজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উপরি পাওনা ছাড়া অফিসের ফাইলে স্বাক্ষর না হওয়া, মিথ্যা কথা বলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা, প্রয়োজন ছাড়া ডাক্তারগণ রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া, ওষুধ কোম্পানি থেকে উপহারসামগ্রী গ্রহণ করে প্রেসক্রিপশনে অতিরিক্ত ওষুধ লেখা, জমির খারিজা সৃজন করার ফি হিসেবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা, এতিমদের নামে টাকা তুলে যথাযথ ব্যয়খাতে সে টাকা ব্যয় না করা। স্বার্থপরতা ও প্রতারণা যখন কারও পেশায় পরিণত হয়, তখন এ জাতীয় অমানবিক ও মনুষ্যত্ববোধ পরিপন্থি কাজগুলো ব্যাপকতা লাভ করে। আর মানুষ হারায় তার মূল পরিচয়; প্রশ্নবিদ্ধ হয় শিক্ষা, নৈতিকতা ও কাঙ্ক্ষিত মানবতা। তাই আল্লাহতায়ালা নেক কাজে সহায়তা আর মন্দ কাজে সহায়তা বর্জনের তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নেক কাজ ও আল্লাহভীতির কাজে একে অপরকে সাহায্য কর। গোনাহ ও অবাধ্যতার কাজে একে অপরকে সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা মায়িদা : ২)।

হালাল খাদ্য খাওয়া : ঈমানের পর একজন প্রকৃত মানুষের অন্যতম গুণ হলো- হালাল খাদ্য খাওয়া। হারাম খেলে বংশপরম্পরায় এর মাশুল গুনতে হয়। সাধারণত উপার্জন হারাম হলে মানুষের স্বভাব ও চরিত্র পবিত্র রাখা যায় না। হারাম উপার্জনকারীর সন্তান কখনও মানুষ হয় না, সৎপথে পরিচালিত হয় না। মুহাদ্দিসগণ বলেন, প্রকৃত নেককার মানুষ হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো, হালাল উপার্জন করা ও হালাল খাদ্য খাওয়া। হালাল খাদ্য খাওয়া নবীদের বৈশিষ্ট্য। মোমিন বান্দাদেরও আল্লাহতায়ালা হালাল খাদ্য খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে হালাল ভক্ষণ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল উপার্জন করা ফরজের পর একটি ফরজ।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৭৮১)।

তওবা করা : নেককার প্রকৃত মোমিন বান্দা সর্বদা গোনাহমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। কৃত পাপের জন্য সে প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তওবা করে। তওবা ও ইস্তিগফারের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আবশ্যকভাবে ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তার প্রত্যেক সংকীর্ণতা থেকে উত্তরণের পথ খুলে দেন। প্রত্যেক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করেন। তাকে আশাতীত রিজিক দান করেন।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৩৩৯)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘আল্লাহর কসম, নিশ্চয় আমি আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করি এবং প্রতিদিন সত্তর বারের বেশি তওবা করি।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৩২৩)।

অনর্থক কাজ বর্জন করা : যে কাজে দুনিয়া বা আখেরাতের কোনো উপকারিতা নেই, মোমিন বান্দা বা প্রকৃত খাঁটি মানুষ সে কাজ করে না। তা থেকে বিরত থাকে। অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা ইসলাম ও মুসলিমের সৌন্দর্য; প্রকৃত মানুষের অন্যতম গুণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইসলামে মোমিন ব্যক্তির সৌন্দর্য হলো, অনর্থকবিষয় বর্জন করা।’ (তিরমিজি : ২৩১৮)। রুচিহীন, অশালীন ও অশ্রাব্য সকল বিষয় থেকে বিরত থাকা একজন প্রকৃত মানুষের অনন্য গুণ।

অহংকারমুক্ত হওয়া : মানুষ যখন অন্যের তুলনায় কোনো বিষয়ে এগিয়ে থাকে, তখন স্বভাবতই নিজের ভেতর অহংবোধ ও দাম্ভিকতা কাজ করে। প্রকৃত মানুষ এ আমিত্বকে সংযত করে অহংকারমুক্ত থাকে। অহংকারমুক্ত থাকার ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অহংকার, খেয়ানত ও ঋণমুক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৯২০)।

প্রতারণা থেকে দূরে থাকা : একজন খাঁটি মুসলমান, প্রকৃত মানুষ কখনও অন্যের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে না। কথায়, কাজে কিংবা আচরণে মানুষকে ঠকাতে পারে না। কারণ, প্রতারণা করা মোমিন বান্দার গুণ নয়; উম্মতে মুহাম্মদির বৈশিষ্ট্য নয়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৫২)।

অন্যকে নিজের মতো ভালোবাসা : প্রকৃত মানুষ নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা অন্যের জন্যও পছন্দ করে। নিজের জন্য যা অপছন্দ করে, তা অন্যের জন্যও অপছন্দ করে। এটা মোমিনের আলামত; প্রকৃত মানুষের গুণ। রাসুল (সা.) এ বিষয়ে বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, তা তার অন্য (মুসলিম) ভাইয়ের জন্যও পছন্দ না করবে।’ (মুসলিম : ৪৫)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত