ঢাকা ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৮ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরোপকারে আত্মার পরিশুদ্ধি

দিদার শফিক
পরোপকারে আত্মার পরিশুদ্ধি

পরোপকার একটি মানবিক গুণ। এ গুণের চর্চা মানুষকে আত্মিকভাবে প্রশান্তি দেয়। একটি সুন্দর মন ধারণ ও কল্যাণকর চেতনা লালনের মধ্য দিয়ে পরোপকারের বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে। পরোপকার নামক গুণ মানুষের আত্মাকে পরিশীলিত ও পরিশুদ্ধ করে। অন্যের ভালো চাওয়া ও কল্যাণ করার নামই মূলত পরোপকার। সহজে বলা যায়, বিনিময় ছাড়া অন্যের উপকার করাকে পরোপকার বলে। মানুষের অন্তরাত্মা আল্লাহর খুশির জন্য প্রস্তুত না হলে, মন্দ বর্জনে হৃদয়-মন কাতর না হলে সাধারণত মানুষ নেক কাজ করতে পারে না। পরোপকারও একটি নেক কাজ। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব প্রাপ্ত হয়। পরোপকারের ফজিলত সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন পূরণ করবে, আখেরাতে আল্লাহ তার ১শ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে, আল্লাহ তার প্রতি দয়ার দৃষ্টি দেন।’ (মুসলিম : ২৫৬৬)।

মানুষ সামাজিক জীব। একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া মানুষ সমাজে চলতে পারে না। সুন্দর ও মানবিক জীবন গঠন করা যায় না- যদি পারস্পরিক সহায়তা না থাকে। অসহযোগিতা সৃষ্ট মানবতাশূন্যতাকে পূর্ণতায় রূপ দেয়ার লক্ষ্যে নবী (সা.) বলেন, ‘মোমিনরা একটি দেহের মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম : ২৫৮৬)। অন্য হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনও অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে।’ (বোখারি : ৬০১১)।

ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণকর কাজে একে অন্যের জন্য উপকারী হওয়া ইসলাম ধর্মের শিক্ষা। ইসলাম সব সময় মানুষের কল্যাণ চায়। দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষ যেন সফল হতে পারে সে জন্য ইসলামে রয়েছে নানান নির্দেশনা। বিশেষত মানুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য উদ্দীপনামূলক অনেক নির্দেশনা রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন এবং ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সম্পর্কের সুখময় বন্ধন ও হৃদ্যতাপূর্ণ ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার অনেক কারণ ও পদ্ধতি আছে। তবে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো একে অপরের সহযোগিতা করার মানসিকতা থাকা। পবিত্র কোরআনে নেক কাজে একে অন্যকে সহায়তা করার নির্দেশ রয়েছে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের (পরোপকারের) জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা আলে-ইমরান : ১১০)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ তাকওয়া ও নেক কাজে তোমরা একে অপরের সহযোগিতা করো। তবে পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো না। (সুরা মায়িদা : ২)। এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা সাহায্য করার একটি মূলনীতি বলে দিয়েছেন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়সহ সকল কল্যাণকর কাজে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সাহায্য করার নির্দেশ রয়েছে এ আয়াতে। পাশাপাশি গোনাহের কাজে সহায়তা না করার নির্দেশ রয়েছে।

ভাই ভাইকে সহায়তা করা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে জালিম হোক বা মাজলুম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! মাজলুমকে সাহায্য করার ব্যাপারটি তো বুঝলাম কিš‘ জালিমকে সাহায্য করব কীভাবে? রাসুল (সা.) বললেন, জুলম থেকে বিরত রাখাই হচ্ছে জালিমকে সাহায্য করা। (বোখারি ও মুসলিম)। অন্য হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ সেই (সাহায্যকারী) বান্দার সাহায্যে থাকেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)।

পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য, অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাই পরোপকারের চেতনায় মোমিনমাত্রই উজ্জীবিত হয়। কেননা রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মোমিন মিলেমিশে থাকে। যে মিলেমিশে থাকতে পারে না, তার মধ্যে কল্যাণকর কিছু নেই। আর যে ব্যক্তি মানুষের খুব উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত : ৫৭৮৭)।

পরোপকার করা সবার ভাগ্যে জুটে না। কারণ এটিও একটি ইবাদত। ইবাদত বদকার লোকের কপালে জুটে না। তাই সমাজে দেখা যায়, অনেক বিত্তবান লোক সমাজের কল্যাণকর কাজে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করার সুযোগ পায় না। বরং বলা উচিত, তাদের নসিব হয় না। অথচ রাসুল (সা.)-এর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যের উপকার করে মানসিক তৃপ্তি পাওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম অহিপ্রাপ্তির পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে খাদিজা (রা.)-কে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও, আমি আমার প্রাণনাশের আশঙ্কা করছি।’ তখন খাদিজা (রা.) নবীজি (সা.)-কে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ কখনোই আপনার অমঙ্গল করবেন না। কারণ, আপনি আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করেন, গরিব-দুঃখীর জন্য কাজ করেন, অসহায়-এতিমের ভার বহন করেন, তাদের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।’ (বোখারি : ৪৫৭)।

পরোপকারী হওয়ার জন্য অনেক ধন-সম্পদের মালিক হওয়া জরুরি নয়। প্রতিটি মানুষ শুধু মন থেকে ইচ্ছে করলেই তার নিজ অবস্থানে থেকে পরোপকারী হতে পারে।

শুধু অর্থ দিয়ে নয়, কাউকে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে, পথিককে পথ দেখিয়ে, কারও বিপদে পাশে থেকে সমবেদনা জ্ঞাপন করে; বেদনাকাতর ও দুঃখী মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে কিংবা নেক ও কল্যাণকর কাজে সময়, শ্রম ও সঙ্গ দিয়েও পরোপকারী হওয়া যায়। সমাজে এখন সহায়তামূলক বন্ধনের বড় অভাব দেখা দিয়েছে। বিনিময় ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে না। কোনো কাজে একটু সম্মতি প্রকাশ, সশরীরে ক্ষণিকের জন্য উপস্থিতি কিংবা সামাজিক বিচার-আচার কোনও কিছুই এখন অর্থপ্রাপ্তি ছাড়া হয় না। এটা সামাজিক অবক্ষয়। আত্মার অপরিশুদ্ধতা সৃষ্ট অনাচার। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের অন্তরকে মানবিক গুণে সমৃদ্ধ করতে হবে। নবী (সা.)-এর আদর্শ ও চরিত্র ধারণ করে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ও মুহূর্ত যাপন করতে হবে। প্রতিটি কাজ ও পরিকল্পনা হতে হবে কল্যাণ ও গোনাহমুক্ত রীতি ও পন্থায় সম্পাদিত। এ জন্য প্রয়োজন ভালো ও মন্দ স্বভাবের জ্ঞান লাভ করা। তখন মন্দ বর্জন করে সৎ ও সততার পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে।

লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ঢাকা আইডিয়াল সিটিজেন মাদরাসা, মানিকনগর, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত