এক লোক অন্য একজনের বাগানে গাছে উঠে ফল ছিঁড়তে। গাছের শাখায় ঝাঁকুনি দিলে কাঁচাপাকা ফল ঝরে পড়তে থাকে। টের পেয়ে বাগান মালিক বেরিয়ে এসে ডাক দেয়, আমার বাগানের গাছে কে রে? লোকটি জবাব দেয়, আল্লাহর এক বান্দা, আল্লাহর গোলাম। আল্লাহর ইশারায় চলি। তার ইচ্ছায় কাজ করি। তার আদেশের বাইরে কিছু করার ক্ষমতা আমার নাই। মালিক বলে, ভালোই তো আল্লাহর নেক বান্দা। আল্লাহকে ভয় কর না। লাজশরম কোথায়। দিনে দুপুরে কীভাবে আমার বাগানে চুরি কর, কথা বল বড় গলায়?
গোফত আয বা’গে খোদা বান্দায় খোদা
গর খোরাদ খোরমা কে হক কর্দাশ আতা
বলল, আল্লাহর বাগানে আল্লাহর এক বান্দা
যদি খায় খেজুর আল্লাহই তো দিয়েছেন তা।
লোকটি বাগানের মালিকের জবাবে বলল, আমি আল্লাহর গোলাম। এই বাগানের মালিকও আল্লাহ। কাজেই আল্লাহর বাধ্যগত বান্দা যদি আল্লাহর বাগান হতে খেজুর পেড়ে খায় আপত্তি কোথায়? আল্লাহর বান্দা আল্লাহর বাগানের ফল খেয়েছে তাতে আপত্তি করার আপনি কে? আল্লাহর মাল নিয়ে কৃপণতা দেখাচ্ছেন, আপনারই তো লজ্জা করা উচিত। নির্বোধের মতো কথা বলছেন!
বাগান মালিক মনে মনে বললেন, এ তো সাধারণ চোর নয়; রীতিমতো দার্শনিক। জবরি মতবাদী। জবরিয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা বলে, তকদিরে যা লেখা আছে মানুষ তার কাছে বন্দি। নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি, স্বাধীন কর্মক্ষমতা বা ভালো মন্দ বাছাই করে চলার অধিকার মানুষের নেই। মানুষ পুতুলের মতো। তকদিরের সুতার নাটাই তাকে নাচায়। মানুষ যাকিছু করে নিয়তিতে লেখা আছে বলেই করে। চিন্তা করলেন, তর্ক করে এই লোককে বুঝানো যাবে না। বুঝাতে হবে হাতে কলমে। কাজের লোকটিকে ডাক দিলেন, জলদি রশিটা নিয়ে আয়। লোকটাকে পেঁচিয়ে বাঁধল দুজন মিলে গাছের সঙ্গে। তারপর বাগান মালিক চাবুকের ছন্দ তুললেন লোকটির পিঠে নিতম্বে দক্ষ হাতে। লোকটির আর্তচিৎকার কে দেখে।
গোফত আখের আয খোদা শরমী বেদা’র
মী কুশি ইন বী গোনাহ রা যারে যারে
বলল, আল্লাহর প্রতি লজ্জা করুন, কী করছেন
একজন নির্দোষ মানুষ নির্দয়ভাবে মেরে ফেলছেন।
আমার মতো একটি অসহায় মানুষকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে মেরে ফেলছেন। আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবেন। বাগানের মালিক এবার মুখ খুললেন,
গোফত আয চুবে খোদা ইন বান্দা এশ
মী যনদ বর পুশতে দীগর বান্দা এশ
বলল, আল্লাহর লাঠি দিয়ে তার এই বান্দা
আল্লাহর আরেক বান্দার পিঠেই মারছে ঘা।
এখন কেন এত চেঁচামেছি? সবকিছু আল্লাহর। আমার হাতের লাঠিও আল্লাহর। আল্লাহর সেই লাঠি দিয়ে আল্লাহর এক গোলাম আরেক গোলামকে পিটাচ্ছে, তাতে আপত্তি কর কেন?
বেদড়ক পেটান খাওয়ার পরই লোকটির মাথায় ঢুকল জবরিয়া মতবাদ ভ্রান্ত। বলল, আমি তওবা করলাম। আমার যুক্তি, আমার দর্শন সম্পূর্ণ ভুল। মানুষ প্রকৃতির হাতের ক্রীড়নক নয়। ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি’ মতবাদ ভ্রান্ত। মানুষের এখতেয়ার আছে। ভালো মন্দ যাচাই করে চলার অধিকার ও স্বাধীনতা মানুষকে দেয়া হয়েছে।
মওলানা রুমি আরো বলেন, মানুষকে যে এখতেয়ার দেয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতেই তার উপর আদেশ নিষেধ বা শরিয়তের হুকুম আহকাম বর্তায়। যদি মানুষকে এখতেয়ার দেয়া না হত, মানুষ যদি পুতুলের মতো পরাধীন ক্ষমতাহীন ক্রীড়নক হত, তাহলে শরীয়তের হুকুম পালন করা বা না করার জন্য পুরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা থাকত না।
তবে কি মানুষকে দেয়া এই এখতেয়ার নিরঙ্কুশ? মানুষ কি নিজের ইচ্ছায় সবকিছু সবকাজ করতে পারে, সম্পূর্ণ স্বাধীন? এখানে একটি সূক্ষ্ম ফারাক আছে। নিরঙ্কুশ এখতেয়ার বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র আল্লাহর হাতে। আল্লাহর সেই এখতেয়ার হতেই মানুষ এখতেয়ার লাভ করেছে। অশ্বারোহী যখন ঘোড়া দাবড়ায় ধূলার কুন্ডলী উত্থিত হয়ে আকাশ ছেয়ে যায়। বাইরে থেকে তখন ধূলোর কুন্ডলীই দেখা যায়। ধূলিঝড়ের মধ্যে ধাবমান ঘোড়া ও অশ্বারোহী নজরে আসে না। মানুষের এখতেয়ারের নেপথ্যে লুক্কায়িত আল্লাহর এখতেয়ারের উপমা এই ধূলি-কুণ্ডলীর ভেতরের অশ্ব ও অশ্বারোহী।
সৃষ্টিজগতের সবকিছু দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। একটি শ্রেণির নিজস্ব এখতেয়ার নেই। যেমন জড়জগৎ। এদের উপর যে কেউ কর্তৃত্ব চালাতে পারে; কিন্তু আল্লাহ মানুষকে এখতেয়ার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের উপর কর্তৃত্ব চালানোর অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তবে তার অর্থ এই নয় যে, মানুষের কোনো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নেই; বরং আল্লাহর দেয়া কর্তৃত্বের সে অধিকারী। এ জন্যেই তার উপর আল্লাহর হুকুম আহকাম বর্তায়। মানুষের কোনো ক্ষমতা না থাকলে আল্লাহতায়ালা শরিয়তের বিধিবিধান পালনের হুকুম দিতেন না। পাগল ও শিশুকে শরিয়তের হুকুম আহকাম পালনে বাধ্য করা হয় না। কারণ, তাদের নিজের উপর নিজের এখতেয়ার নেই। গরুর কথা চিন্তা কর। গরু যদি জোঁয়াল কাঁধে নিতে না চায়, মারা হয়। কারণ জোঁয়াল কাঁধে নেয়ার ক্ষমতা বা এখতেয়ার তার আছে। কিন্তু আকাশে না ওড়ার কারণে গরুকে কখনো শাস্তি দেয়া হয় না। কারণ, সবাই জানে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা গরুর নেই।
ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কাঁধে জোঁয়াল নিতে তেড়ামী করায় যদি গরুকে পেটান হয়, তাহলে গরুর মালিক কীভাবে অক্ষমতার দোহাই দিয়ে আল্লাহর শাস্তি হতে রেহাই পাবে। কাজেই অসুস্থ না হয়ে অসুস্থতার ভান করো না। আল্লাহর দেয়া নেয়ামত এখতেয়ার নিয়ে মস্করা করবে না। ‘আল্লাহ যা চান তাই হয়ে যায়’ আল্লাহর এই বাণীর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তুমি কাজে কর্মে অলসতা দেখাবে। বরং তোমার নিষ্ঠা আর কাজের উদ্যম সঞ্চয় করতেই ইনশাআল্লাহ (আল্লাহ যদি চান) বলার নির্দেশ।
হে তরুণ! ব্যাপার যদি এমন হয় যে, তুমি যা চাইবে তাই হবে, সবকিছু তোমার ইচ্ছানুযায়ী চলবে, তাহলে তুমি অলসতা দেখালে মেনে নেয়া যেত। কেননা, শেষ পর্যন্ত তুমি যা চাও তাই তো হবে। কিন্তু যদি ব্যাপার এমন হয় যে, আল্লাহ যা চান তাই হবে, তোমার চাওয়ার সাথে আল্লাহর চাওয়া যুক্ত হতে হবে, তাহলে তোমাকে শতগুণ উদ্যম নিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। ব্যাপারটি বুঝার জন্য একটি উদাহরণ নাও। একজন মন্ত্রী কোনো দেশে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তখন কি তুমি সেই মন্ত্রীর আনুকুল্য পাওয়ার চেষ্টা করবে, নাকি মন্ত্রীর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে?
কাজেই জবরি হয়ে ‘আল্লাহ যা চান তাই হবে’- উক্তির অপব্যাখ্যা করে বল না যে, আমি কোনো চেষ্টা করব না। অলস বসে থাকব, আল্লাহ যা চান তাই তো হবে।’ বরং তোমার উচিত সেই পরম ক্ষমতাময়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা, তার দয়াদৃষ্টি লাভে জীবনের গতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া। যদি তাকে ছেড়ে যাও, তার সাহায্য না চাও তবে তোমার জীবন হবে হতাশায় ভরা। উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা যদি তোমার মধ্যে অলসতার সৃষ্টি করে নিশ্চিত জানবে যে, কোরআনের বিকৃত ব্যাখ্যায় তুমি বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছ। কোরআনের কোনো আয়াতের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে হলে অন্য আয়াতের সাহায্য নিতে হবে। তোমার চেতনাকে জাগ্রত করার জন্যই তো ইনশাআল্লাহ বলতে হবে। তাতে মহামহিমের শক্তির সংযোগে যে কোনো কঠিন অবস্থা অতিক্রম করার শক্তি তোমার মধ্যে সঞ্চারিত হবে।
ওহে জবরি! তুমি কি বলতে চাও যে, আল্লাহতায়ালা বেকার হয়ে আছেন। অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনায় যে হুকুম দিয়েছেন তারপর তিনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তিনি কিনা বলছেন যে, আমি সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছি। তারপরে আমার কোনো দায়িত্ব নেই। আমার করার কিছু নেই। তোমরা আমার কাছে আসবে না। কান্নাকাটি করবে না। আমার সাহায্য চাইবে না। নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহতায়ালা সম্বন্ধে এমন বিশ্বাস পোষণ করতে রাজি হবে না। কেননা, তিনি রব্বুল আলামীন বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। প্রতি মুহূর্তে তিনিই সবকিছু চালাচ্ছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন। অতএব, ‘জাফফাল কলম’ (কলম শুকিয়ে গেছে; তকদিরের লিখন চূড়ান্ত হয়ে গেছে) এর অর্থ তুমি যা বলতে চাও, তা নয়। এর অর্থ নেকির বদলায় পুরস্কার আর বদির বদলায় শাস্তির বিধান চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এটিই যাফফাল কলম, আল্লাহর বিধান চূড়ান্ত হওয়ার মর্ম।
তুমি হয়ত বলবে, শাস্তি দেয়ার বিধান থাকলেও আল্লাহ ইচ্ছা করলে অপরাধীকে মাফ করে দিতে পারেন। হ্যাঁ, তিনি অপরাধীকে মাফ করে দিতে পারেন। আবার মাফ নাও করতে পারেন। কাজেই তুমি কীসের আশায় বসে থাকবে। তাছাড়া কোনো বাদশাহ অপরাধীকে ক্ষমা করে জেল থেকে মুক্তি দিলেও তাকে তো মন্ত্রী বানায় না। কাজেই তুমি জবরি হয়ে পাপে লিপ্ত হবে না। চেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা কর। সামান্য কুকুরও ঘরের দরজায় আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলে মালিকের আদরে সিক্ত ও প্রিয়ভাজন হয়। কিন্তু বাদশাহর ছেলে হয়েও যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাদশাহ তার গর্দান উড়ায়। কাজেই হে জবরি, তালবাহনা ছাড়। আল্লাহর আনুগত্যের পথ ধর। তার প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা কর। শয়তানের মতো যুক্তি সাজিও না। ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করে বিতাড়িত হয়। পরে আদেশ অমান্যতার দোষ চাপায় স্বয়ং আল্লাহর উপর। সে যুক্তি দিয়েছিল, আল্লাহ চাইলে আদমকে সিজদা করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। বলল, ‘যেহেতু তুমি আমাকে গোমরাহ করেছ তাই মানুষকে তোমার পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমি ওঁতপেতে থাকব। (সুরা আরাফ : ১৬)। অন্যদিকে আদম বেহেশতে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার পর কৈফিয়ত চাওয়া হলে তকদিরকে দায়ী না করে সরাসরি নিজের ভুল স্বীকার করেছিলেন। তাতে আল্লাহর দরবারে বরিত ও প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। বস্তুত শয়তানের যুক্তি ভর করেছে জবরিয়াদের মাথায়। তারা কথায় কথায় তকদিরে অতিবিশ্বাস বা তাওয়াক্কুলের দোহাই দিয়ে বলে, সবকিছু আল্লাহ করবেন, আমার করার কিছু নাই। আজকের বিভ্রান্তরা সে কথাই বলে ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ?’ কোনো অন্যায় বা অপশক্তি দেখলে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে বলে, আল্লাহই ওদের দমন করবেন।
(মওলানা রুমির মসনিব শরিফ, ৫খ. বয়েত-৩০৭৭-৩১৬৪) (ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)