ঢাকা রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এতেকাফের বিধান

শরিফ আহমাদ
এতেকাফের বিধান

এতেকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আত্মশুদ্ধি, ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এতেকাফ সুপ্রাচীন ইবাদত হওয়ায় যুগে যুগে এর আমল হয়েছে। ইতেকাফ করার জন্য মসজিদকে পবিত্র রাখা নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ দিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সুরা বাকারা : ১২৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এতেকাফের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তিনি শুধু নিজে এতেকাফ করতেন না, বরং সাহাবা কেরামকে উৎসাহিত করতেন। এ সংক্রান্ত জরুরি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো।

এতেকাফের শর্তগুলো : এতেকাফ আদায় করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মানতে হয়। শর্ত মেনে এতেকাফ করলে তা শুদ্ধ হবে এবং ইবাদতের পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে। এতেকাফের প্রধান শর্ত তিনটি। এক. এতেকাফের নিয়ত করতে হবে। দুই. এমন মসজিদে এতেকাফ করতে হবে, যেখানে নামাজের জামাত হয়। জুমার জামাত হোক বা না হোক। তিন. মহিলাদের ক্ষেত্রে হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র হতে হবে। (আহকামে জিন্দেগী : ২৫৭)।

এতেকাফের প্রকার : এতেকাফ তিন প্রকার। এক. ওয়াজিব। এটা হলো? মান্নতের এতেকাফ। মান্নতের এতেকাফের জন্য রোজা শর্ত। সুন্নত এতেকাফ ফাসেদ হয়ে গেলেও তার কাযা আদায় করা ওয়াজিব। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি জাহিলিয়্যাতের যুগে মসজিদে হারামে এক রাত এতেকাফ করার মান্নত করেছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তোমার মান্নত পুরা কর। তিনি এক রাতের এতেকাফ করলেন।(বোখারি :১ ৯১৪)। দুই. সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। এটা হলো রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশক এতেকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) এতেকাফ করতেন। (বোখারি: ১৮৯৯)। রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এতেকাফের সময়। বড় গ্রাম বা শহরের প্রত্যেকটা মহল্লা এবং ছোট গ্রামের পূর্ণ বসতিতে কেউ কেউ এতেকাফ করলে সকলেই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে । আর কেউই না করলে সকলেই সুন্নাত তরকের জন্য দায়ী হবে। তিন. মুস্তাহাব বা নফল। এই এতেকাফের জন্য কোন দিন বা সময়ের পরিমাপ নেই এবং রোজাও শর্ত নয়। অল্প সল্প সময়ের জন্যও তা হতে পারে।

নারীদের এতেকাফের স্থান : পুরুষদের মতো নারীদের জন্যও রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ সুন্নত। এজন্য বাড়িতে মহিলাদের নিজের ঘরে আগ থেকে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলে, সেখানে অথবা জায়গা নির্ধারিত করে সেখানে এতেকাফ করা সর্বোত্তম। এটাই নিরাপদ এবং সওয়াব অর্জনের মাধ্যম। তবে কোন মহিলা যদি মসজিদে পূর্ণ পর্দার সাথে এতেকাফ করে, তাহলে তা মাকরুহের সঙ্গে আদায় হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একাধিক স্ত্রী মসজিদে এতেকাফ করতে চাওয়ায় তিনি তখন এতেকাফ করেননি। পরে কাজা আদায় করেছেন। এখান থেকে বোঝা গেল এতেকাফের বিধানটি মূলত পুরুষদের জন্য মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত । নারীদের জন্য নয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এতেকাফ করতেন। আমি তাবু তৈরি করে দিতাম। তিনি ফজরের নামাজ আদায় করে তাতে প্রবেশ করতেন। হাফসা (রা.) তাঁবু খাটাবার জন্য আয়েশা (রা.) এর কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে অনুমতি দিলে হাফসা (রা.) তাবু খাটালেন। জয়নাব বিনতে জাহশ (রা.) তা দেখে আরেকটি তাঁবু তৈরি করলেন। সকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁবুগুলো দেখলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এগুলো কী? তাকে জানানো হলে তিনি বললেন, তোমরা কি মনে কর এগুলো দিয়ে বেশি নেকি হাসিল হবে? এ মাসে তিনি এতেকাফ ত্যাগ করলেন এবং পরে শাওয়াল মাসে দশ দিন (কাযা স্বরূপ) এতেকাফ করেন। (বোখারি: ১৯০৫)।

এতেকাফ ভাঙার কারণ : এতেকাফ পালনের জন্য কিছু নিয়ম ও শর্ত আছে। এগুলো মেনে চলা আবশ্যক। যদি কেউ শর্তভঙ্গকারী কোনো কাজ করে, তাহলে তার এতেকাফ ভেঙে যাবে। এক. স্ত্রী সহবাস করলে এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। চাই বীর্যপাত হোক বা না হোক, ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর তোমরা মসজিদে এতেকাফরত অবস্থায় তাদের সাথে মিলিত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। কাজেই এগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না। (সুরা বাকারা : ১৮৭)।

দুই. শরিয়তসম্মত প্রয়োজন বা স্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া এতেকাফের স্থান থেকে বের হলে এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। শরিয়তসম্মত প্রয়োজন হলে বাইরে যাওয়া যায়; যেমন ফরজ বা সুন্নাত গোসলের জন্য বের হওয়া ইত্যাদি। আর স্বাভাবিক প্রয়োজনেও বের হওয়া যায়; যেমন- প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া, খাদ্য-খাবার এনে দেয়ার লোক না থাকলে খাওয়ার জন্য বের হওয়া, ইত্যাদি। যে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া হবে, সে কাজ সমাপ্ত করার পর দ্রুত ফিরে আসতে হবে। বিনা প্রয়োজনে কারও সাথে কথা বলবে না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে থাকাবস্থায় আমার দিকে মাথা বাড়িয়ে দিতেন আর আমি তা আঁচড়িয়ে দিতাম এবং তিনি যখন এতেকাফে থাকতেন, তখন (প্রাকৃতিক) প্রয়োজন ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতেন না। (বোখারি : ১৯০২)।

এতেকাফ করার পুরস্কার : এতেকাফের অনেক ফজিলত এবং ফায়দা রয়েছে। এতেকাফের একটা ফায়দা হলো এতেকাফকারী গোনাহ থেকে মুক্তি পাওয়াটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এতেকাফকারী সম্পর্কে বলেন, সে নিজেকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকি তার জন্য লেখা হয়। ( ইবনে মাজা : ১৭৮১)। আরো বেশ কিছু হাদিসে এতেকাফের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পুরস্কার লাইলাতুল কদর। এতেকাফকারী ব্যক্তির ভাগ্যে এটা পাওয়া সুনিশ্চিত। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বোখারি : ১৮৯৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত