কতক মূর্খ মজনুর কাছে গিয়ে বলল, দেখ মজনু! লাইলীর জন্য তুমি যে দেওয়ানা, এটা তোমার বোকামি ছাড়া আর কিছু না। লায়লী তো এমন সুন্দর নয়, যেরূপ তোমার কল্পনা। আমাদের শহরে তার চেয়ে রূপসী উর্বশী অনেক মেয়ে আছে, চেহারা চাঁদের বরণ, প্রাণকাড়া গড়ন। তাদের জবাবে মজনুর সাফ কথা, তোমরা লাইলীর বাইরের আকৃতি দেখেছ ভেতরের প্রকৃতি দেখনি। সুরাহী দেখেছ, সুরাহীর ভেতরের শরাবের মাদকতা দেখনি। সুরাহী বলতে সবকিছুর বাহ্যিক আকৃতি রূপমাধুরী, আর ভেতরের শরাব মানে অন্তর্গত সৌন্দর্য সুষমা। সুরাহীর আকৃতি সুন্দর না হলেও তার ভেতরকার শরাবে মাদকতা থাকতে পারে। লাইলীর অস্তিত্বের যে সুরাহী তোমরা দেখেছ তার ভেতরে আল্লাহ আমার জন্য প্রেমের শরাব লুকিয়ে রেখেছেন। লাইলীর অস্তিত্বের সুরাহী হতে তোমরা পেয়েছ সিরকা (ভিনেগার), তাই লাইলীর প্রেম তোমাদের আকর্ষণ করতে পারেনি। শুনো, আমার কাছে যা মধু তোমাদের কাছে তা সিরকা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কারণ, আল্লাহ আপন কুদরতে একই কলসি হতে কাউকে মধু আর কাউকে সিরকা দিতে পারেন। তোমরা লাইলীর বইরের রং-রূপে সৌন্দর্য দেখতে চেয়েছ, তার ভেতরের খোঁজ নাওনি। কারণ, বাহ্যিকতার দিকেই তোমাদের নজর। বাঁকা চোখ ও চিন্তা দিয়ে আধ্যাত্মিক সুধা, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য দর্শন কী করে সম্ভব?
মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, আত্মিক প্রেরণাকে বেহেশতি হুরের সাথে তুলনা করা যায়। হুর ও রূপসীরা আচ্ছাদিত থাকে তাঁবুর ভেতর। আধ্যাত্মিকতার রূপমাধুরিও লুকিয়ে আছে সৃষ্টিলোকের বাহ্যিক আকৃতির তাঁবুর ভেতর। হুরদের রূপমাধুরী একান্ত আপনজনের কাছেই উদ্ভাসিত হয়। সৃষ্টিলোকে বিরাজিত আধ্যাত্মিক সুধাও কেবল আপন লোকেরাই পান করতে সক্ষম। কোরআনে বেহেশতি হুরদের নাম ‘কাসেরাতুত তরফ’। অর্থ, তারা নিজের রূপমাধুরী শুধু স্বামীদের কাছেই প্রকাশ করবে। স্বামী ছাড়া কারো কাছে আপন সৌন্দর্য সুধার প্রকাশ ঘটাবে না। আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও রহস্যাদির উপমাও তাই। একান্ত আপন ও যোগ্য লোক ছাড়া এই রহস্য কারো কাছে ধরা দেয় না।
সাগরের কথা চিন্তা কর, সাগরকে তুলনা করতে পারি তাঁবুর সাথে। সাগরের ভেতরে লুকায়িত রহস্য কেউ দেখে না। সাগরের জল হাঁসের জন্য প্রাণের বাহন; অথচ কাকের জন্য ডেকে আনে মরণ। আরেকটি উদাহরণ, বিষ সাপের জন্য খাদ্য ও প্রাণবর্ধক; অথচ অন্যদের জন্য প্রাণের ঘাতক। কাজেই এই জগতে নেয়ামত হোক বা লানত সবার জন্য এক সমান নয়, আপেক্ষিক; একই জিনিস হতে পারে একজনের জন্য দোযখ অন্য কারো জন্য বেহেশত।
মূলকথা হলো, তোমরা সৃষ্টিলোকের সবকিছুর বাইরের আকৃতি দেখতে পাচ্ছ; ভেতরের প্রকৃত অবস্থা দেখার চোখ তোমাদের নেই। সবকিছুতে খাদ্য ও জীবনী শক্তি যেমন আছে তেমনি আছে প্রাণের ঘাতক জহর-হলাহল। বস্তুর জাহেরি অবয়ব মানুষের সামনে উদ্ভাসিত; তার ভেতরকার জীবনবর্ধক উপাদান খুব কম লোকই জ্ঞাত।
ইউসুফ (আ.)-এর উদাহরণ চিন্তা করতে পার। ইউসুফের বাহ্যিক আকৃতি ছিল সুন্দর জামবাটির মতো। সেই বাটি দিয়ে তার পিতা শতসহস্র আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও রূপের সুধা পান করেছিলেন। কিন্তু ইউসুফের ভুবন মাতানো সৌন্দর্য তার ভাইদের কাছে ছিল বিষ হলাহলের মতো, যা তাদের মধ্যে হিংসা, ক্রোধ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছিল। আবার ইউসুফের এই সৌন্দর্যও সবার কাছে একরকম ছিল না। যুলাইখা ইউসুফের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল কামনার শরাব পিয়ে। আফিমের মতো মাদকতায় সে মজেছিল। কিন্তু পিতা ইয়াকূব এর কাছে ইউসুফের রূপসুধার উপলব্ধি ছিল ভিন্নতর। তিনি রুহানি খোরাক পেতেন পুত্রের পয়গাম্বরসুলভ রূপ ও ব্যবহার দেখে। মোটকথা একই সুরাহীর শরাব কারো জন্য মধু, আবার কারো জন্য বিষের মতো। সেই মধুর মধ্যেও তারতম্য আছে। ইউসুফের রূপের উপলব্ধি পিতার কাছে আধ্যত্মিক আর যুলাইখার কাছে কামনা আশ্রিত জৈবিক।
আত্মিক শরাব আসে গায়বি জগৎ হতে আর সুরাহীর সম্পর্ক এই জগতের সাথে। কারণ, আধ্যাত্মিক চেতনা ও অবস্থার সম্পর্ক গায়বী জগতের সাথে আর বাহ্যিক আকৃতির সম্পর্ক ইন্দ্রিয়গত পার্থিব জগতের সাথে। এই আধ্যত্মিক শরাব না-মাহরাম বা ‘পর’পুরুষের দৃষ্টি থেকে লুকায়িত। তবে যারা মাহরাম একান্ত আপনজন তাদের কাছে উদ্ভাসিত। মওলানা রুমি এ পর্যায়ে উপলব্ধি করেন যে, আল্লাহর সাহায্যের হাতছানি না হলে কেউ ঊর্ধ্বজগতের আধ্যাত্মিক সুরা পান করতে পারবে না। তাই আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করছেন কায়মনোবাক্যে আরবিতে।
ইয়া ইলাহী সুক্কিরাত আবছারুনা
ফা‘ফু আন্না উস্কিলাত আউযারুনা
ইয়া ইলাহী! আমাদের চোখগুলো মাদকাসক্ত
আমাদের ক্ষমা কর গুনাহের বোঝায় আমরা নূব্জ ।
ইয়া খাফিয়্যান কদ মালা‘তাল খাফেকাইন
কদ আলাউতা ফাউকা নূরিল মশরেকাইন।
হে গোপন সত্তা উভয় জগৎ তোমার নুরে উদ্ভাসিত
পূর্ব পশ্চিমের জ্যোতির গণ্ডি তুমি ছাড়িয়ে গেছ।
আন্তা সিররুন কাশেফু আসরারিনা
আন্তা ফজরুন মুফজেরু আনহারিনা
তুমি রহস্য আমাদের যত রহস্য কর উদ্ভাসিত
তুমি ভোর, আমাদের দিনগুলো কর আলোয় স্নাত।
আই খফিয়ায যাতি মাহসূসুল আতা
আন্তা কালমায়ী ওয়া নাহনু কার রাহা
তুমি গোপন সত্তা তোমার দানসমূহ প্রকাশিত
তুমি পানি হয়ে চালাও আমাদের অস্তিত্বের যাঁতা।
আন্তা কাররীহে ওয়া নাহনু কাল গোবার
তখতফীর রীহু ওয়া গাবরাহা জেহার
প্রভুহে! তুমি বাতাসের মতো আর আমরা ধুলিবালি
বাতাস অদৃশ্য থাকে ধুলোবালিই দৃশ্যমান দেখি।
আগের দিনে গম ভাঙিয়ে গুড়া তৈরির যাঁতাকল চলত পানির তোড়ে। যাঁতাকলের পানির তোড়ের মতোই তোমার সত্তা ও গুণাবলি আমাদের চোখের অন্তরালে আড়ালে; কিন্তু তোমার তাজাল্লির উদ্ভাস সর্বত্র দৃশ্যমান। পানির গতি যেভাবে যাঁতাকলের চরকি ঘুরায় তুমিও আমাদের জীবনে গতির প্রবাহ। তুমি বায়ুর মতো আর আমরা ঝড়ের ধুলোবালি। ঝড়ে বায়ু থাকে লুকানো অদৃশ্য, ধূলোবালিই সবাই দেখি। তুমি বসন্ত; আমরা বাগানে সবুজের সমারোহ। তুমি গোপন তবে তোমার দান-অবদান প্রকাশিত। তোমার তুলনা প্রাণের মতো, আমাদের তুলনা হাতপা বহিরাঙ্গ। হাতপায়ের শক্তির উৎস তো আমাদের প্রাণসত্তা। তোমার তুলনা আকল-জ্ঞানবুদ্ধি আর আমাদের তুলনা জিহ্বা-রসনা। এই জিহ্বা আকলের কাছ থেকেই পায় ভাষার জোগান, কথা বলার প্রেরণা। তোমার উপমা আনন্দ আর আমরা মুখের হাসি। হাসি উৎসারিত আনন্দের গহিন থেকে। আমাদের গতি, চলন-বলন প্রতিমুহূর্তে সাক্ষ্য দেয় মহামহিম আল্লাহর অস্তিত্বের।
গোটা সৃষ্টিজগতেই তো সাক্ষ্য বিরাজমান মহান স্রষ্টা মহামহিম মালিকের। মওলানা রুমি এখন উপলব্ধি করেন, এই যে উপমা উদাহরণগুলো দেয়া হলো আসলে আল্লাহর মহান সত্তার পরিচয় দিতে এর কোনোটিই যথার্থ নয়। কারণ, তিনি মানুষের ধারণা কল্পনার ঊর্ধ্বে, তর্ক বাহাসের প্যাঁচাল দিয়ে বুঝানো যাবে না তার পরিচয়। তার মতো কিছুই নেই। কোনো উপমা দিয়ে তাকে বুঝানোর সাধ্য কারো নেই। এমন চেষ্টা যে বা যারা করে তাদের মুখ ও মাথা ধূলোমলিন হওয়া চাই।
আই বুরুন আয ওয়াহম ও কাল ও কীলে মন
খাক বর ফরকে মন ও তামছীলে মন
ওহে যিনি আমার ধারণা অনুমান নানান কথার ঊর্ধ্বে অনেক
ধুলোমলিন হোক আমার মাথার তুলি ও যত উপমার প্যাঁচাল।
মওলানা রুমির মনের কানে কারো একটি আপত্তি সে বাজল, মওলানা! আপনার এসব কথা ও বর্ণনা, নানা উপমা-মেছাল যদি আল্লাহর মহান সত্তা, অস্তিত্ব ও গুণাবলির স্বরূপ প্রকাশে অক্ষম হয়, এই কারণে যদি আপনার মাথায় তুলিতে ও এসব কথার ফুলঝুরিতে মাটি নিক্ষিপ্ত হওয়া উচিত মনে করেন, তাহলে কেন এতসব উপমা উৎপ্রেক্ষা দিয়ে আল্লাহর মারেফাত ও পরিচয়ের স্বরূপ বুঝানোর চেষ্টা করছেন? মওলানা এর জবাবে বলছেন, তোমার এই প্রশ্ন, এমন আপত্তি সঠিক। কিন্তু আমার মন যে মানে না। আমার ভেতরে আল্লাহর প্রেমের তোলপাড় যে আমার প্রাণ গোপন রাখতে পারে না, আমি যে নিরূপায়। প্রেমের রহস্য ফাঁস না করলে প্রাণের যে শান্তি নাই। আল্লাহর মহান সত্তা ও তার গুণাবলি সম্বন্ধে যেসব সুন্দর চিন্তা ও উপলব্ধি মনের মাঝে উদিত হয় তা বেরিয়ে পড়ার জন্য অস্থির ও বেকারার হয়ে যায়। তাই এলোমেলো কথায়, নানা ছলছুতায় প্রেমের কাহিনি ব্যক্ত করি। আমার প্রিয়তমের পরিচয় দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করি।
আমার অবস্থা মুসা (আ.)-এর সেই রাখালের মতো, যে আল্লাহর মাথার চুল আঁছড়ে দেয়ার আবদার করেছিল। বলেছিল, হে খোদা! এসো আমার কাছে, এই রাখালের পাশে। আমি তোমার চুল আঁছড়ে দেব। তোমার জামার উকুনগুলো বেছে দেব। তোমার ছেঁড়া আলখেল্লায় তালি দিয়ে সিলাই করে দেব। তোমার আঁচলে প্রেমের চুমো এঁকে দেব। এই রাখাল এতখানি বেসামাল ছিল যে, আল্লাহর প্রেমে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। কিন্তু সে তসবীহ পাঠ ও আল্লাহর গুণগান করতে জানত না। আল্লাহর প্রেমের সাগরে যখন তরঙ্গ আসে সেই তরঙ্গের ঢেউ খেলে যায় রাখালের হৃদয়পটে। কিন্তু অন্যরা আল্লাহ-প্রেমের তরঙ্গের কিছু শব্দ ও আওয়াজ শুনে সেগুলোই বলে বেড়ায়। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-৩২৮৬-৩৩২৪)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)