সুলতানুল আরেফিন বায়েযিদ বোস্তামি (রহ.)-এর জামানার কথা। একজন নেককার লোক প্রতিবেশী এক কাফেরকে গিয়ে বলল, ভাই! তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান আন। নেক বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যাও। তাতে দুনিয়ার জীবনে সম্মানিত হবে, আখেরাতেও চিরন্তন আজাব থেকে রেহাই পাবে। কাফের লোকটি বলল,
গোফত ইন ঈমান আগর হাস্ত আই মুরীদ
আঙ্কে দা’রদ শেখে আ’লম বা’য়েযিদ
বলল, এই ঈমান যদি হয় হে মুরিদ! এমন
জগতের শেখ বায়েযিদের সাচ্ছা ঈমান যেমন।
হে বায়েযিদ বোস্তামির মুরিদ! আপনি যে আমাকে ঈমান আনার দাওয়াত দিচ্ছেন, তা যদি জগতের শিরোমণি বায়েযিদ বোস্তামির ঈমানের মতো হয়, তা হলে তো আমি পারব না। তার মতো ঈমানদার হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ, বায়েযিদ বোস্তামি আল্লাহর প্রতি যতখানি নিবেদিতপ্রাণ, মানুষের অধিকারের প্রতিও ততখানি স্পর্শকাতর।
কথিত আছে, একবার বৃষ্টির দিনে পিছলে পথে চলতে গিয়ে বায়েযিদ বোস্তামি (রহ.) পা ফসকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন। তখন নিরূপায় হয়ে একটি বাগানের দেয়াল ধরে আছাড় থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। পরে তিনি সেই বাগানের মালিকের কাছে গিয়ে অনধিকার চর্চার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। এমনই ছিল বায়েযিদ বোস্তামির তাকওয়ার জীবন।
লোকটি বলল, আমি কাফের, ইসলামের প্রতি অবিশ্বাসী বটে; তবে বায়েযিদ যে ঈমান পোষণ করেন সেই ঈমানের প্রতি আমি বিশ্বাসী দৃঢ়ভাবে। আমি বিশ্বাস করি, বায়েযিদ এর ঈমান বর্তমান দুনিয়ায় সবার ঈমানের সেরা। তিনি বড় বিনম্র, আলোকিত হৃদয়, সম্ভ্রমের অধিকারী আল্লাহর ওলী। বায়েযিদের ঈমানের প্রতি আমার ঈমান অকৃত্রিম।
অপরদিকে যে ঈমান আনার জন্য দাওয়াত দিচ্ছেন তা যদি আপনাদের ঈমানের মতো হয়, তা হলে সে ঈমানের দরকার আমার নেই। সে ধরনের ঈমানে আমার মোটেও আগ্রহ নেই। কারণ হলো, আপনাদের ঈমান দেখলে ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী লোকদের মনটাও শীতল হয়ে যায়। তারা ঈমানের ফল ও ফসলরূপে কোনো সৎকর্মের দৃষ্টান্ত আপনাদের জীবনে দেখে না। উল্টা যা দেখে, আপনাদের কথা ও কাজে মিল নেই। চলনে বলনে চরিত্রে মুনাফেকির চালচিত্র। তখন ঈমান ও ইসলামের জন্য অধীর আগ্রহীরাও মনোবল হারিয়ে বসে। নাম শুনে লালমিয়া, কাছে গিয়ে দেখে কালো, কুৎসিত কদাকার কায়া। আপনারা কথায়-হাবভাবে ঈমানদার, মুখের বুলিতে-বেশভূষায় নেককার; কিন্তু আপনাদের দাবি ফাঁকা স্লোগানের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ফলে আপনাদের মতো মুসলমানরাই ইসলামের জন্য কলঙ্ক।
মওলানা রুমি আরো বলেন, বিষয়টি বুঝার জন্য আরেকটি ঘটনা বলি। একজন মুয়াজ্জিন ছিলেন বড় কর্কশ তার গলার আওয়ায। শ্রোতার কান ঝালপালা করত তার আজানধ্বনি। কাফের প্রধান এক মহল্লায় গিয়ে তিনি আযান দিতে চান। মুসলমানরা তাকে বলল, নামাজের জন্য কাফেরদের জনপদে তুমি আযান দিও না। তোমার আযানের কর্কশ শব্দ সামাজিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। কাফেরদের সাথে আমাদের দাঙ্গা বেঁধে যাওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু মুয়াজ্জিন না-ছোড় বান্দা। সে আযান দেবেই। কারো বারণ মানবে না। কিছুতেই থামবে না। কাফেরদের মহল্লায় দাঁড়িয়ে দরাজ কণ্ঠে আজান দিলেন। মুসলমানরা তো ভয়ে অস্থির। না জানি, কোন ফেতনা ছড়িয়ে পড়ে, নতুন করে মুসলমানদের রক্ষপাত শুরু হয়। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে মুসলমানরা দেখল যে, একজন কাফের একটি সুন্দর জামা নিয়ে উপস্থিত। মিষ্টান্নের একটি প্যাকেটও আছে জামার সাথে। বন্ধুসুলভ মনোভাব নিয়ে হাদিয়া এনেছেন মুয়াযযিনের জন্য। বিধর্মী লোকটি জানতে চাইল, মুয়াযযিন কোথায়? তার এমন সুললিত কণ্ঠস্বর। মুসলমানরা বলল, কী বলছেন, এই মুয়াযযিনের আওয়ায তো বড় কর্কশ। কীভাবে আপনি বলতে চান, তার কণ্ঠস্বর সুললিত, হৃদয়গ্রাহী? কাফের বলল, আজকে যে মুয়াযযিন আযান দিয়েছেন তার আওয়াযই আমাদের মন্দিরে পৌঁছেছে। আসলে আমি তার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতার প্রমাণ নিয়ে এসেছি জামা ও মিষ্টান্নের হাদিয়া নিয়ে।
মুসলমানদের তো বিস্ময়ের অন্ত নেই। মুয়াজ্জিনের কী কারামাত ফলে গেল, আমরা বুঝতে পারলাম না। কাফের ব্যাখ্যা করল, আমার একটি মেয়ে আছে অতি আদরের। সে অনেকদিন থেকে মুসলমান হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। আমাদের সমাজের জ্ঞানী-গুণিজন, আত্মীয়-স্বজন তাকে অনেক বুঝিয়েছি, তুমি মুসলমান হতে যেও না। বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হওয়ার পাগলামি ছেড়ে দাও। সে কারো বারণ মানবে না। তার সাফ কথা আমি মুসলমান হবই। কারণ, ইসলাম তার হৃদয়নগরে প্রবেশ করেছিল, যেভাবে কারো অজান্তে কয়লার ভেতরে আগুন স্থান করে নেয়। আমি বড় কষ্টে ছিলাম, মানসিক যন্ত্রণার অন্ত ছিল না। নিজের জাত-ধর্ম ত্যাগ করে আমার মেয়েটা মুসলমান হয়ে যাবে, তা কিছুতেই আমরা মেনে নিতে পারছিলাম না। দিন যতই যাচ্ছিল ইসলামের প্রতি তার ভালোবাসা ও আগ্রহ বেড়েই যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আপনাদের মুয়াজ্জিনের আযান আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়েছে।
লোকটি আরো ব্যাখ্যা দিল, আমার মেয়ে যখন আপনাদের মুয়াজ্জিনের আওয়ায শুনতে পেল, বলল: এমন ঝাঁঝালো কর্কশ আওয়াযটা কীসের? এই জনপদে তো এমন বিশ্রি ভ্যাঁ ভ্যাঁ জীবনে শুনিনি। তার বোন তাকে বলল, এ তো মুসলমানদের আহ্বান। তাদের উপাসনায় মানুষকে ডাকার জন্য এভাবেই আওয়ায দেয়া হয়। যাকে বলা হয় আযান। এটিই ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্যসম্বলিত সাধারণ ঘোষণা। ইসলাম গ্রহণের জন্য উদ্গ্রীব আমার মেয়েটি বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে আরো লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হলো, এটি সত্যিই মুসলমানদের আযান। নামাজ ও ইসলামের আহ্বান। নিশ্চিত হওয়ার পর তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ইসলাম গ্রহণের জন্য তার আগ্রহে ভাটা পড়ল। তখনই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। গেল রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারলাম। আমার অস্থিরতার চিন্তার অবসান হলো। বস্তুত এই মুয়াজ্জিনের আযান আমার জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে এবং এ কারণেই তার জন্য পুরস্কার নিয়ে এসেছি।
চোন বেদীদশ গোফত ইন হাদিয়া পযীর
কে মারা গশতি মুজীর ও দস্তগীর
মুয়াযযিনকে দেখেই বলল, এই হাদিয়াটুকুন আপনি
গ্রহণ করুন, ওহে আমার মুক্তিদাতা ও উদ্ধারকারী।
আমার কাছে যদি দুনিয়ার সম্পদ, রাজত্ব ও ঐশ্বর্য থাকত, তাহলে আপনার মুখণ্ডগহ্বর ভরে দিতাম স্বর্ণে ও মণিরত্নে।
মওলানা এবার ফিরে আসছেন বায়েযিদ বোস্তামি ও প্রতিবেশী কাফেরের প্রসঙ্গে। তিনি বলছেন, তোমাদের ঈমানও কাফের এর দেশে কুৎসিত কর্কশ আওয়াযে আযান দেয়া মুয়াজ্জিনের আযানের মতো ঈমান ও ইসলামের পথে ডাকাতস্বরূপ। বায়েযিদ বোস্তামির ঈমানের কথা বলব। বায়েযিদ ঈমানের হক আদায় করেছেন। বায়েযিদ যদি তার ঈমানের একটি বিন্দু সাগর বুকে দান করেন, সাগর তার বিশালতা সত্ত্বেও বায়েযিদের ঈমানের বারিবিন্দুর মাঝে ডুবে হারিয়ে যাবে। কামিল মুসলমানের ঈমান আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো। শুকনো পাতার ঝোপঝাড়ে যদি আগুনের স্ফুলিঙ্গ পতিত হয় কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো বনজঙ্গল পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কামিল বান্দার ঈমানও অন্তর্জগৎ হতে কুফরি নাফরমানির চিন্তা ও চরিত্র জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেয়। তাবৎ কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে শুকনো বনে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো বাতিলের বেড়াজাল নস্যাৎ করে দেয়। কামিল বান্দার ঈমানের শক্তিমত্তার উপমা সেই চিন্তার মতো, যা কোনো রাজার বা সেনাপতির মস্তিষ্কে জাগ্রত হলে যুদ্ধের দামাম বেজে উঠে এবং শত্রু নিধন করে সম্মুখের সবকিছু ধ্বংস-লীলায় পরিণত করে।
হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর জীবনও দেখ, ঈমানের সেতারা বুলন্দ ছিল তার কপালে। সেই সেতারার ত্যেজে কাফেরদের সব আয়োজন তছনছ হয়ে দেন। ঈমানের সেতারার জ্যোতির অবস্থা হলো, যারা ঈমান খুঁজে পেয়েছে তারা আল্লাহর নিরাপত্তার আশ্রয়ে চলে গেছে। আর যারা ঈমানের সম্পদ হতে বঞ্চিত তারা কুফরি ও নাফরমানির জঞ্জালে নাজেহাল অবস্থায় হাবুডুবু খায়। পরকালে তো নির্ঘাত জাহান্নাম আছেই।
মওলানা আরো বলেন, আমার কথাগুলো আক্ষরিক অর্থে নিও না। কারণ, আমার কথার প্যাঁচাল ও যুক্তিতর্কের স্বরূপ হচ্ছে পানি আর তেল একত্রে মেশানোর চেষ্টার মতো, যে চেষ্টা কোনোদিন সফল হবে না। কামিল বান্দার ঈমানকে আমি আগুনের স্ফুলিঙ্গের সাথে তুলনা করেছি। অথবা বলেছি যে, এই ঈমান পরমাণুর মতো। পরমাণুকে মনে করা হয় দেদিপ্যমান সূর্যের দহনশক্তির অবিভাজ্য অংশ। কিন্তু এসবই তো কথার কথা। প্রকৃত অবস্থা, বায়েযিদ বোস্তামির বা কামিল বান্দার ঈমান যদি তার হৃদয়ের উদয়াচল থেকে বিচ্ছুরিত হয়, তা হলে দেশগ্রাম কেন আকাশ বাতাস ত্রিভুবন আলোর বন্যায় ভেসে যাবে। বায়েযিদ বোস্তামির বা ইনসানে কামেল (পূর্ণ মানব) এর পরিচয় আমি কীভাবে দেব। তার একটি দেহ আছে। দেহের মধ্যে একটি রুহ আছে। এখন কি তার রুহকে কামিল বলব, নাকি তার দেহগত কাঠামোকে? এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আমার কাছে নেই। পূর্ণ ঈমানদারের হাকিকত যদি তার আলোকিত হৃদয় হয়, তা হলে তার দেহকে কী বলব, তুমিই বল। আমার এই বিহ্বলতার ব্যাখ্যা পাবে বিড়ালের গোশত খাওয়া নিয়ে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার প্যাঁচালে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-৩৩৫৬-৩৪০৮)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)