ঢাকা রোববার, ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২৩৫)

ঊর্ধ্বলোকের সূর্যের সন্ধানী হও

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ঊর্ধ্বলোকের সূর্যের সন্ধানী হও

এক লোকের বউটা ছিল দুষ্টু প্রকৃতির, লোভী ও পেটুক। বউয়ের দুর্ব্যবহার নীরবে সহ্য করা ছাড়া উপায় তার ছিল না। সারাদিন পরিশ্রম করে যা কিছু ঘরে আনত, বউ তা উজাড় করত নির্ভয়ে। একদিন বাড়িতে মেহমান আসবে, বেচারা চেষ্টা করে এক কেজি গোশত কিনে দিয়ে এলো বউয়ের হাতে। তাজা গোশত দেখে বউ তো খুশিতে আটখানা। পুরো এক কেজি গোশত কাবাব বানিয়ে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল মহিলা মেহমান আসার আগেই। কাজের ফাঁকে লোকটি বাড়ি এসে জানতে চাইল, মেহমানের রান্নাবান্না কতদূর হয়েছে, গোশত পাকানো হয়েছে কি না? স্ত্রীকে বলল, মেহমান কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছবেন। স্ত্রীর তখন উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগল। মহিলা পরিষ্কার বলে দিল, গোশত নেই, গোশত বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। দরকার মনে করলে আবার গোশত কিনে আন, রান্না করে দিতে আমার আপত্তি নেই। বাড়িওয়ালা বুঝতে পারে, বউয়ের চালাকি। গোলামকে বলল, তুমি বিড়ালটা ধর আর দাঁড়িপাল্লা নিয়ে এসো। আমি পাল্লায় তুলে দেখব বিড়াল আর গোশতের ওজন। দেখা গেল, বিড়ালের ওজন এক কেজির বেশি নয়। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওহে মিথ্যুক পেটুক! বিড়াল গোশত খায়নি, এই গোশত তুমিই হজম করেছ। এক কেজি একশ গ্রাম গোশত আমি ওজন দিয়ে এনেছি, অথচ এই বিড়ালের ওজন এক কেজির বেশি নয়। সেই গোশত খেয়ে থাকলে বিড়ালের ওজন তো হওয়ার কথা দুই কেজি। অথচ এখন বিড়ালের ওজন এক কেজিরও কম। এই গোশত গেল কোথায়?

ইন আগার গুরবেস্ত পস আন গূশত কূ

ওয়ার বুয়াদ ইন গূশত গুরবে কু বজূ

এই যদি হয় বিড়ালের ওজন গোশত কই

এগুলো যদি গোশত হয়, বিড়াল গেল কই।

এই ওজন যদি গোশতের হয় বিড়ালের গোশত কোথায়? আর যদি বিড়ালের ওজন নিজস্ব হয় এক কেজি, গোশত গেল কই?

হে বায়েযিদ বোস্তামি! ওহে ইনসানে কামেল! আপনার ভেতরে যে রুহ তা যদি আপনি হন, তাহলে আপনার বাইরের দেহ কাঠামোর পরিচয় কী হবে? আর যদি দেহের কাঠামো আপনি হন, বলুন কী বলব আপনার রুহকে? দৈহিক কাঠামো ও রুহ নিয়ে মানবসত্তা গঠিত। একটি অপরটির বিপরীত। একটি বস্তুগত জাগতিক, আরেকটি আত্মিক আধ্যাত্মিক। এখানে কোন পরিচয়টা আসল। রুহ না দেহ? নাকি রুহ ও দেহের পরিচয় অভিন্ন সমন্বিত? এই প্রশ্ন বড় জটিল।

হাইরত আন্দর হাইরতাস্ত আই য়্যারে মন

ইন ন কা’রে তুস্ত ওয়া ন হাম কা’রে মন

বিহ্বলতার ভেতরে বিহ্বলতা নহে বন্ধু বোধগম্য

এ রহস্য বুঝার না তোমার, না আমার আছে সাধ্য।

আল্লাহর হেকমতই এই দুই বিপরীতকে পরস্পর যুক্ত করেছে। উভয়ের মিশ্রণে জীবন ও সংসার সুখের হয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নয়। দেহের কাঠামো যদি না থাকে রুহ কীভাবে, কার উপর ভর করে কাজ করবে? আর যদি রুহ না থাকে তাহলেও তো তোমার দেহ অকেজো পড়ে থাকবে। আল্লাহর অপার হেকমতের রহস্যের কারণে তোমার দেহের কাঠামো দৃশ্যমান। অথচ তোমার দেহের চালিকাশক্তি রুহ থাকে অদৃশ্যমান। বিস্ময়কর হলো, এই দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে পৃথিবীর সমস্ত কাজ সুচারুরূপে চলমান ও বিকাশমান। এর একটিকে বাদ দিলে অন্যটি অচল। মুঠ ভরে মাটি নিয়ে যদি কারো মাথায় মার, মাথা ভাঙবে না। আর যদি মাথার উপর পানি ঢাল তাতেও মাথার ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি মাটি ও পানি একত্রে মিশ্রিত হয়, তখন মাটির শক্ত দলা তৈরি হলে আঘাতে মাথা ফেটে যায়। বস্তুত এভাবেই বস্তু ও আত্মার সমন্বয়ে জীবন ও সংসার শক্তিশালী হয়। আবার যখন মরণ আসবে দেহ ও আত্মা পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যাবে। রুহ চলে যাবে রুহের জগতে আর দেহ মিশে যাবে পানি, মাটি, বাতাস ও সূর্যের উত্তাপে। রহস্যময় হলো, পরস্পরবিরোধী, সাংঘর্ষিক দুটি সত্তার মিলন-মিশ্রনে মানবজীবন ও জগৎ-সংসার পরিচালিত। এই রহস্যটি বুঝতে পারলেই জীবন ও জগৎকে উপলব্ধি করা সহজতর হবে।

মওলনা রুমি (রহ.) আমাদের চিন্তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে বলতে চান, বস্তু ও আত্মার জগতের বৈপরিত্যের মাঝে সমন্বয়ের কথা বলা হলো। স্বয়ং আত্মার জগতেও পরস্পর বৈপরিত্য আছে। কিন্তু এই বৈপরিত্য ও সমন্বয়ের স্বরূপ কী, তা না কোনো কান কোনদিন শুনেছে, আর না কোনো চোখ দেখেছে। এই জগৎ আরো রহস্যময়। আল্লাহর এককত্বের সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দোল খায় এখানে সব বৈপরিত্য পরস্পরের গলায় ঝুলে। এই রহস্যময় জগৎ মানুষের বোধগম্য কেন নয়, তা একটি কথা চিন্তা করে বুঝবার চেষ্টা কর। তোমার এই কান যদি আত্মিক জগতের কোনো ধ্বনি শুনতে পায়, তাহলে কি নিজের অবস্থায় বহাল থাকতে পারবে? কানের অস্তিত্বই তো বিপন্ন হবে। সামান্য সূর্যের দিকে তাকালে যেখানে সবার চোখ ধাঁধিঁয়ে যায়, সেখানে ঊর্ধ্বলোকের রহস্য দর্শনের সাধ কীভাবে পূরণ হবে?

আরো উদাহরণ সামনে আন। প্রখর সূর্যের চেহারা দেখে বরফ লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গলে যায়। তখন বরফ থেকে বের হয় স্বচ্ছ নির্মল পানির ঝর্ণাধারা। সেই পানি গাছ-গাছালির জ্বরাজীর্ণতা দূর করে প্রাণের শিহরণ জাগায়। সেই পানি পান করে মানুষ প্রাণ জুড়ায়। তোমার মধ্যে যে বস্তুগত স্বভাব ও দেহিক কাঠামোর চাহিদা তার উপমা এই বরফ। তাকে তুমি বিনয় ও নফস দমনের মাধ্যমে সূর্যের চোখ দেখে বরফ গলার মতো গলিয়ে ফেল। তোমার দ্বারা জগৎ ও জীবন আলোকিত হবে। অন্য মানুষ ও সমাজ-সংসার উপকৃত হবে। চিন্তা কর, বরফ যদি জমাট শক্ত হয়ে থাকে বাগানের গাছগাছালি তার উপকার হতে বঞ্চিত হয়। তোমার মধ্যে যদি কামনা বাসনা প্রবল থাকে, জৈবিক স্বভাবের তাড়না যদি দমিত না হয়, যদি হাকিকতের সূর্যের দিকে চেয়ে তুমি নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দিতে না পার, তাহলে তোমার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হবে না। তার ফল্গুধারায় সমাজ আলোকিত হবে না, তোমার চারপাশ ও পরিবেশ উন্নত হবে না। জমাট বরফতুল্য সেই দেহের অবস্থা হলো-

লাইসা য়্যালিফ লাইসা ইউলাফ জিসমুহু

লাইসা ইল্লা শুহহা নাফসিন কিসমুহু

কারো সাথে মিশে না, কেউ তার সাথে মিশে না

কৃপণ সে আত্মমগ্ন, মানুষ মানুষের জন্য-তা জানে না।

মওলানার এই বক্তব্য হাদিস শরিফের হুবহু প্রতিধ্বনি। হাদিস শরিফে বর্ণিত “মোমিন ব্যক্তি অন্য লোকের সঙ্গে সখ্য হয়, অন্তরঙ্গ মিশে। অন্যরাও তার সাথে সখ্য হয়, মিশে। যে ব্যক্তি কারো সাথে মিশে না বা অন্য কেউ তার সাথে মিশে না, তার মধ্যে কল্যাণ নেই। লোকদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে মানুষের অধিক উপকার সাধন করে।” (তাবারানি, বায়হাকি)।

ওহে সাধক! তুমি সূর্যের দেখা পাওয়ার চেষ্টা কর। তোমার উপর যখন তার প্রখর নজর পতিত হবে, তখন তোমার মধ্যকার বস্তুগত আবর্জনা, জৈবিক কামনা বাসনা গলে যাবে। তবে একেবারে নষ্ট হবে না। জমাট বরফ পানিতে রূপান্তরিত হবে। সেই পানিতে জীবন জাগবে। কোরআন মাজিদে বর্ণিত- ‘তবে তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। আল্লাহ তাদের পাপ পরিবর্তন করে দেবেন পুণ্যের দ্বারা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা ফুরকান : ৭০)।

কাজেই বড় কথা সূর্যের তাপে তাপিত হওয়া। সেই সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশের নয়; আরো ঊর্ধ্বের। তার রহমতের ছোঁয়ায় তোমার পুরো জীবন বদলে যাবে। এতদিনকার খারাপভাবে জীবন যাপনের অভ্যাস সৎ ও নেক কর্মে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তবে সেই সূর্যের দেখা পাওয়া সহজ নয়। তার জন্য তোমার হৃদয়ে অর্জন করতে হবে স্বচ্ছতা। হৃদয়ের আয়নাকে মেলে ধরতে হবে আকাশের পানে। তার সাথে কথা বলতে হবে মনের আলাপনে, গোপনে ।

মওলানার সাথে সুর মিলিয়ে আমরা বলতে চাই, কুতুবদিয়ার বাতিঘর সমুদ্রগামী জাহাযকে পথ দেখায়। কতক আল্লাহর বান্দা আছেন তারাও মানুষকে ঊর্ধ্বলোকের পথ দেখান। তাদের চলায় বলায় শুধু আল্লাহর স্মরণ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত তাদের জীবন। তারা তোমাকে ঊর্ধ্বলোকের সূর্যের সন্ধানী হওয়ার প্রেরণা যোগান। তুমি তাদের সন্ধান কর।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-৩৪০৯-৩৪৩৮)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়াপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবীর গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত