হযরত ঈসা (আ.)-এর জমানার কথা। এক আমীর ছিলেন শরাবে আসক্ত। তবে তার চরিত্র ছিল উদার, গরিব দরদী, বিশ্বাসীদের আস্থাভাজন ও রহস্যজ্ঞানী। তখনকার দিনে শরাব পান হারাম ছিল না। তবে আল্লাহ প্রেমিক দ্বীনদার লোকেরা মনে করত, শরাব দ্বীনের পথে চলার অন্তরায়। এ কারণে ধর্মগুরু, আমীর বা সাধকদের জন্য শরাব নিন্দনীয় ও গর্হিত ছিল। একদিন রাতের বেলা আমীরের কাছে মেহমান আসে। তখন প্রয়োজন দেখা দেয় বাড়তি শরাবের। আমীর চাকরকে নির্দেশ দেন, দ্রুত গিয়ে অমুক বৈরাগীর কাছ থেকে শরাব কিনে নিয়ে এসো। তার কাছে নিখাঁদ শরাব আছে, যা পান করলে শরীর রোমাঞ্চিত আর অন্তরের পর্দা খুলে যাবে। তুমি গিয়ে দেখবে, লোকটা একেবারে সাধারণ। গায়ে ছেঁড়া আলখেল্লা তার আচ্ছাদন। তুমি তার বাইরের অবয়বের দিকে তাকাবে না। চোরের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য যেমন স্বর্ণের উপর কালো প্রলেপ দেয়া হয়, তিনিও মানুষের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজেকে আড়ালে রেখেছেন বেষভূষায়। গুপ্তধন থাকে বিরান ভূমিতে পরিত্যক্ত বসতভিটায়, তুমিও অমূল্য রত্ন পাবে তার কাছে, যা পাওয়া যায় না অভিজাত এলাকার জৌলুস ও জলসায়। আদম (আ.)-এর গুপ্তধন লুকায়িত ছিল তার দেহ কাঠামোর অভ্যন্তরে। ফলে ইবলিস চিনতে পারেনি আদমের স্বরূপ, বাতেনী হাকিকত। তাই আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করে। কাজেই তুমি দ্রুত চলে যাও প্রেমের শরাব বিক্রেতা সংসারত্যাগীর কাছে।
চাকর বাতাসের বেগে গিয়ে কিনে নিল শরাবের সুরাহী। রাতের আঁধার দীর্ণ করে ছুটে চলল আমীরের বাসভবনের পানে। এ তো এমন শরাব, যা পান করলে দেহ ও প্রাণ একাকার হয়ে যাবে। আত্মহারা দুনিয়ার চিন্তা লুপ্ত হয়ে সৃষ্টিলোকের এককত্বের সাগরে হাবডুবু খাবে। পথে ছিল পাদ্রিদের আস্তানা। পাদ্রীরা তাদের শরীয়তের আইন কানুনের কড়াকড়ি নিয়ে ব্যস্ত। আত্মিক আধ্যাত্মিক বিষয় তাদের কাছে মূল্যহীন। একজন পাদ্রী তার পথ আগলে জানতে চাইল তোমার হাতে কি? চাকর বলল, আমার হাতের পাত্রে আছে শরাব। কার জন্য, কোথায় নাও? অমুক আমীরের নির্দেশে এত রাতে কিনে নিয়ে যাচ্ছি মেহমান আসছে তাই। একথা শুনে পাদ্রীর মাথায় আগুন ধরে যায়,
তালেবে য়াযদান ও আনগাহ এইশো নূশ
বাদেয়ে শয়তান ও আনগাহ নীম হুশ
আল্লাহর সন্ধানী, তারপরে শরাব ও আনন্দ-ফূর্তি
শয়তানের শরাব পিয়ে ঠিক থাকবে তোমার মতিগতি?
আমীর তো বড় দ্বীনদার বলে জাহির করেন। কথায় কথায় বলেন, আমি আল্লাহর প্রেমিক, আধ্যাত্মিকতার পথিক; অথচ কীভাবে সম্ভব শয়তানের হাতিয়ার শরাব দিয়ে মেহমান আপ্যায়িত করবেন।
হে আমীর! তোমার জ্ঞান কোথায় গেল, বিবেকের কেমন দুর্দশা? তুমি যদি ছায়া তালাশ কর, দিনের আলোতে কর। রাতের আঁধারে ছায়া খোঁজে বেড়াও, কেমন কথা। শরাব যদিও আমণ্ডজনতার জন্য হালাল; কিন্তু যারা বন্ধুর সন্ধানী তাদের জন্য কীভাবে হালাল হবে? তোমার জ্ঞানবুদ্ধি এমনিতে দুর্বল। তার উপর মাদকতা বাসা বাঁধলে তোমার অবস্থা হবে বেহাল। প্রেমিকদের শরাব তো কলিজা নিংড়ানো রক্তের পেয়ালা। সারাক্ষণ বন্ধুর দর্শন ও মিলন লাভের বাসনায় আকুল থাকা। তাদের চোখ অপলকে তাকিয়ে থাকে পথপানে। পরম বন্ধুর মনজিল তাদের ধ্যানের ঠিকানা। যে প্রেমের পথে তুমি চলেছ তা তো বিপদসংকুল। তোমার বুদ্ধি বিবেচনা এমনিতে দুর্বল; এ অবস্থায় শরাব হালাল হলেও তা তোমার জ্ঞানবুদ্ধিকে করে দিবে অচল। সাধারণ গমের রুটির ভুরিভোজও নফসে আম্মারার জন্য হারাম, জহর। নফসের কামনা-বাসনা পূরণ করলে তা তো হবে প্রাণঘাতী মারাত্মক। কাজেই তোমার নফস যা চায় তুমি তার উল্টা কর।
দুশমনে রাহে খোদা রা’ খা’র দা’র
দুযদ রা’ মিম্বার মানেহ বর দা’র দা’র
আল্লাহর পথের শত্রুকে অপদস্থ কর
চোরকে বসিও না মিম্বরে, শূলীতে চড়াও।
চোরের হাত কাটা তোমার কাছে পছন্দনীয় হওয়া চাই। যদি তার হাত কেটে দিতে না পার, অন্তত তার হাতে বেড়ি দাও। এই চোর নফসে আম্মারা। বান্দার যত নেক কাজের সঞ্চয়, সন্তর্পনে সে তা চুরি করে নিয়ে যায়। এর হাত কেটে দেয়ার দৃঢ় ইচ্ছা তোমার থাকা চাই। না পারলে অন্তত হাতকড়া লাগানোর ব্যবস্থা কর।
গর নাবন্দী দস্তে উ দস্তে তো বস্ত
গর তো পা’য়শ নাশ্কানী পা’য়ত শেকাস্ত
হাত যদি না বাঁধ তার সে বাঁধবে তোমার হাত
তার পা তুমি না ভাঙলে সে ভাঙবে তোমার পা।
কাজেই তুমি কেন তোমার দুশমন নফসে আম্মারাকে শরাবের পানীয় যোগাও। অথচ তাকে কৃচ্ছ্রতার কষাঘাতে বঞ্ছনায় রাখা, হাত পায়ে বেড়ি দিয়ে বন্দিদশায় রাখাই তোমার উচিত। এ কথা বলেই পাদ্রী তার বগলে রাখা পাথর দিয়ে শরাবের পাত্রটি ভেঙে দিল। সুরাহী ভেঙে শরাবে মাটি লালে লাল। আমীরের চাকর বেচারা একেবারে বেকুব। আরো কোনো বিপদ আসে কি না, ভয়ে সে দিল দৌড় আমীরের প্রসাদে। চাকরের গোবেচারা অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে আমীর, কী খবর তোমার? শরাব কই? চাকর সমস্ত ঘটনা খুলে বললে আমীর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, এখনই চলো, আমাকে সেই পাদ্রীর বাড়ি দেখিয়ে দাও। হাতের এই লাঠি আমি তার মাথার ওপর ভাঙব। সে কিসের ‘আমর বিল মারুফ’ সৎকাজের আদেশ দানের কাজ করে। এসব ভেল্কি দেখিয়ে খ্যাতি জোগাড় করতে চায়। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ, বাহবা কুড়ানোর মতলব তার মাথায় ভর করেছে। তার মাথা থেকে শয়তান না তাড়ানো পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হবো না, আজ রাতে ঘুমাব না।
আমীরের অগ্নিমূর্তি দেখে পাদ্রী লুকিয়ে গেল রাতের আঁধারের সুযোগ নিয়ে। আমীরের হইচই হুংকারে মহল্লার লোকরা জড়ো হলো। আমীরের অগ্নিমূর্তি আরও বেসামাল। ‘অসৎ কাজে নিষেধের’ নামে এসব নাশকতার তালিম সে কোথায় পেল, দেখে নেব। লোকরা দেখল, আমীর বেচারা পাদ্রীর ঘরবড়ি ভাঙচুর করবে। সবাই অনুনয়-বিনয় করে বলল, এবারের জন্য তাকে মাফ করে দিন আমীর। লোকটি সরল সহজ কোনো অন্যায় দেখলে পরিণতি চিন্তা করে না, ক্ষেপে যায়। এখানে তার নিজের কোনো স্বার্থ নেই। আপনি তাকে মাফ করে দিন, বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে মাফ করে দেবেন। তাদের জবাবে আমীর আস্ফালন করে, কোথায় গেল হতভাগা, আমার বাড়ির সম্মুখ দিয়ে বাঘ যেতেও ভয় পায়, আমার চাকরের হাতের শরাবের পাত্র ভাঙার সাহস সে কোথায় পায়। শরাব তো তার শরীরের রক্তের চেয়েও দামি। কারো কথা শুনব না; আমি তাকে দেখেই ছাড়ব।
সুপারিশকারী পাড়ার লোকেরা পুনরায় আমীরের কাছে অনুনয়-বিনয় করে, জনাব! সে সহজ সরল মানুষ। এতকিছু চিন্তা করেনি। আপনি একজন আমীর হয়ে কীভাবে সামান্য শরাবের জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন। শরাব পান করে আপনি আনন্দিত হবেন, সুখী হবেন, এই তো। আপনার চেহারায় এখনও যে সুখের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তার সাথে শরাব পানের সুখানুভূতির তুলনা করা অন্যায়। আপনি আমীর, মহানুভব, আপনার কাছ থেকে আমরা মহানুভবতাই চাই।
হে মানুষ! তুমি কেন শরাবের জন্য লালায়িত হবে। তোমার মধ্যেই তো সকল আনন্দ উজ্জীবনী শক্তি নিহিত আছে। তুমি সাগর; অথচ শিশিরবিন্দুর কাছে গিয়ে তুমি তৃষ্ণা নিবারণ করতে চাও। তোমার মাথায় আল্লাহ পরিয়েছেন ‘কাররামনা বনি আদামা’ (আমি বনি আদমকে সম্মানিত করেছি) এর সম্মানের মুকুট। নবীজিকে দিয়েছেন কাওসারের অফুরান শরবত।
জ্ঞানবুদ্ধি বিবেক বিচক্ষণতা তোমারই তো গোলাম। তোমাকে দেয়া এসব মহামূল্যবান রত্ন কেন সস্তায় বিকাও। সমস্ত সৃষ্টিকে নিয়োজিত করা হয়েছে তোমার খেদমতের জন্য। তুমি কেন দুয়ারে দুয়ারে ঘুরো ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে। তুমি বই পড়ে সব জ্ঞান অর্জন করতে চাও, বড় আশ্চর্য লাগে। তুমি নিজেই তো জ্ঞানের সমুদ্র, সামান্য শিশির বিন্দুর মধ্যে আছ লুকিয়ে। তোমার সাড়ে তিন হাত দেহ। এর মধ্যেই তো বিশাল জগত ঘুমিয়ে আছে। কবির ভাষায় ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। কাজেই শরাব ভোগ বিলাসিতা, যৌনতা উন্মাদনার কী মূল্য থাকতে পারে মানুষের কাছে। তুমি নিজেই দেদিপ্যমান সূর্য। আগুনের স্ফুলিঙ্গের কাছে কেন সন্ধান করো উত্তাপ। তোমার ভেতরে লুকিয়ে আছে বিশাল আত্মা। তোমার দেহের চাহিদার অত্যাচারে অবদমিত আত্মা অবিরত ক্রন্দন করে। সেই আত্মাকে বন্ধনমুক্ত করার চিন্তা নেই। নিজের ভেতর থেকে রত্নখনি আবিষ্কারের পরিকল্পনা নেই; অথচ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরছ এই দ্বারে ওই দুয়ারে।
সুপারিশকারীদের উদ্দেশ্যে আমীর বলল, না না, আপনারা ভুল বুঝেছেন। আমি তো দুনিয়ার এই শরাবের জন্য মত্ত নই। আমি দুনিয়াদারদের ভোগ লিপ্সার জন্য লালায়িত নই। আমি তো সেই শরাব পিয়ে বেঁহুশ বেতাব হতে চাই। নজরুলের ভাষায় ‘খোদারই প্রেমের শরাব পিয়ে বেঁহুশ হয়ে রই পড়ে’। সেই শরাব পিয়ে আমি গুলে ইয়াসমীন হয়ে প্রস্ফুটিত হব। দেবদারু শাখার মতো বাতাসের দোলায় কখনো এ পাশে কখনও ওপাশে হেলেদুলে নাচব। খোদার প্রেমের শরাব যার মজ্জাগত হয়েছে সেকি ক্ষণস্থায়ী পচা দুর্গন্ধের কাছেও যেতে পারে। নবী রাসূলগণকে দেখ, তাদের জীবন ছিল নিত্যানন্দে বিভোর। আল্লাহর প্রেমে মজে ছিলেন সারাটা জীবন। তাই তারা দুনিয়ার এসব ভোগবিলাসকে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। তারা প্রাণের পরশে উর্ধ্বালোকের আনন্দ উপভোগ করেছিলেন, ফলে এখানকার খুশি আনন্দ তাদের কাছে মরিচিকা, মায়াজাল, খেলনার প্রলোভনের চেয়ে বেশি কিছু নয়। চিন্তা কর, যে রূপসী প্রেমিকার সঙ্গ পেয়েছে, সেকি কোনো মুর্দা নারীর লাশের সাথে রাত কাটাতে রাজি হবে। এই দুনিয়ার ভোগবিলাসিতা তো রূপসীর মৃত লাশের চেয়ে উত্তম কিছু নয়।
(মওলানা রুমির মসনবী শরীফ, ৫খ. বয়েত-৩৪০৯-৩৪৩৮)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবী শরীফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবীর গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)