ঢাকা মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আবেগ ও ভালোবাসার হজ

আবেগ ও ভালোবাসার হজ

হজ করা ঐসব লোকের ওপর ফরজ, যাদের মাঝে এর শর্তাদি পাওয়া যায়। আর অন্যদের জন্য নফল। নামাজ, জাকাত ও রোজার ন্যায় হজও ইসলামের একটি রোকন। অর্থাৎ বড় সম্মানজনক একটি অত্যাবশ্যকীয় হুকুম।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহরই উদ্দেশ্যে ওই গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। (আলে ইমরান : ৯৭)।

যদি কেউ নামাজ, জাকাত, রোজা সব পালন করে; অথচ ফরজ হজ আদায় না করে, তাহলে এ অবস্থা সেই লোকের নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয়। হজে একটি খাস বিষয় আছে, যা অন্য কোনো ইবাদতে নেই। তা হচ্ছে, অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে কিছু যুক্তি-বুদ্ধিগত বিষয় বোধগম্য হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু হজের পুরো ব্যাপারটিতে প্রেম ও আসক্তির প্রাবল্য লক্ষ্যণীয়। কাজেই হজ কেবল সে ব্যক্তিই করবে যার প্রেম, আকল বা যুক্তি বুদ্ধির উপর বিজয়ী হবে। তবে উপস্থিত ক্ষেত্রে এই প্রেমাসক্তিতে কিছুটা কমতি থাকলেও অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রেমাসক্তিপূর্ণ কাজকর্ম করার দরুন ভক্তি ও আসক্তির মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কাজেই হজ করার মাধ্যমে আল্লাহ্র মহব্বতে কোনো কমতি থাকলে তা পূরণ হয়ে যায়। বিশেষত যদি হজের কার্যাদি আল্লাহ্র মহব্বতেই আঞ্জাম দেয়া হয় তাহলে এই সুফল অবধারিত। আর যার অন্তরে আল্লাহ্র প্রেম ও মহব্বত পূর্ব থেকেই থাকবে, দ্বীনের ব্যাপারে সে কতখানি মজবুত হবে তা সহজেই অনুমেয়। এই আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেল, হজ করায় দ্বীনের উপর মজবুত হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বায়তুল্লাহর চারপাশে তাওয়াফ করা, সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে দৌড়ানো এবং কঙ্কর মারা প্রভৃতি সবকিছু আল্লাহ্র স্মরণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই নির্ধারণ করা হয়েছে। (আবু দাউদ : ১৮৮৮)।

বাহ্যদর্শীদের কাছে যদিও আশ্চর্যজনক মনে হবে যে, এই প্রদক্ষিণ করা, দৌড়ানো ও কঙ্কর মারার মধ্যে যুক্তির দিক থেকে কী ফায়দা আছে? কিন্তু আপনি তাতে লাভ খুঁজতে যাবেন না। এতটুকুই বুঝবেন যে, এটি আল্লাহ্র হুকুম এবং তা আঞ্জাম দেয়াতে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক গভীর হয় আর আল্লাহর প্রতি মহব্বতের পরীক্ষা হয়। তা এভাবে যে, যে কাজ যুক্তিবুদ্ধির আওতায় আসছে না, বান্দা তাও আল্লাহ্র হুকুম হওয়াতে মেনে নিয়েছে। তারপর প্রেমাস্পদ আল্লাহতায়ালার ঘরের আকর্ষণে আত্মহারা হওয়া, তার অলিগলিতে দৌড়াদৌড়ি করা, উ™£ান্তের মতো ঘোরাঘুরি করা প্রভৃতি পরিষ্কার আশেকী বা প্রেমাসক্তির আমল ও তৎপরতা।

হযরত যায়দ ইবনে আসলাম (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,আমি হযরত ওমর (রা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, (এখন তাওয়াফে) কাঁধ হেলে দুলে এবং এক কাঁধ খোলা রেখে তাওয়াফ করার কারণ কি? অথচ আল্লাহতায়ালা তো ইসলামকে (মক্কায়) শক্তিশালী করেছেন এবং কুফরি শক্তি ও কাফেরদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। কিন্তু (এখন সেই কারণ না থাকা সত্ত্বেও) আমরা সে আমলটি ত্যাগ করব না, যেটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় (তার অনুসরণ ও হুকুম পালনের নিমিত্তে) করতাম। (কেননা, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজটি বিদায় হজের সময় আঞ্জাম দিয়েছিলেন।) তখন তো মক্কায় একজন কাফেরেরও অস্তিত্ব ছিল না। (আবু দাউদ : ১৮৮৭)।

হযরত আবেস ইবনে রাবিআ (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা.) হাজরে আসওয়াদের দিকে এসে তাতে চুম্বন করেন। তখন তিনি বলেন, আমি জানি, তুমি একটি নিছক পাথর। (কারো) উপকার সাধন করতে পার না। ক্ষতিও করতে পার না। যদি আমি রাসূূলুল্লাহ (সা)-কে তোমাকে চুমো দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি (কখনোই) তোমাকে চুমো দিতাম না। (আবু দাউদ : ১৮৭৩)।

মাহবুব বা প্রেমাস্পদের পছন্দের জিনিসকে চুম্বন করার কারণ প্রেমাসক্তি ছাড়া আর কী হতে পারে? হযরত ওমর (রা.) তার এই মন্তব্যের দ্বারা এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, মুসলমানরা হাজরে আসওয়াদকে উপাস্য জ্ঞান করে না। কেননা, উপাস্য তো সেই হতে পারে, যে উপকার বা ক্ষতিসাধন করার মালিক।

হযরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজরে আসওয়াদের দিকে ফিরলেন। এরপর তার ওপর আপন (মোবারক) ঠোঁট দু’টি রাখলেন, অনেকক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ অবস্থায় কাঁদতে থাকলেন। তারপর যখন ফিরে তাকালেন, দেখলেন, হযরত উমরও (রা) কাঁদছেন। তিনি বললেন, হে ওমর! এই স্থান অশ্রু বিসর্জন দেয়ার জায়গা। (ইবনু মাজা : ২৯৪৫)।

মাহবুুবের নিদর্শনকে ভালোবেসে কান্নাকাটি করা শুধু প্রেমাসক্তির ফলেই সম্ভব। ভয় বা এ জাতীয় কোনো কারণে এমনটি হয় না। প্রেমাসক্তির কাজ ইচ্ছা করেও করা যায়; কিন্তু কান্নার কাজ আবেগ ছাড়া হবে না। কাজেই হজের সম্পর্ক প্রেম ও ভালোবাসার সাথে, আবেগের সাথে। এই হাদীস দ্বারা বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।

হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এক দীর্ঘ হাদীসে) ইরশাদ করেন, যখন আরাফাতের দিন হয়, (যেদিন হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত থাকেন) তখন আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের কাছে সেসব লোককে নিয়ে গর্ব করে বলেন, আমার বান্দাদের তোমরা দেখ, তারা আমার কাছে দূর-দূরান্তের রাস্তা থেকে এমন অবস্থায় এসেছে, তাদের চুল এলোমেলো ও শরীর ধূলি-ধূসরিত, রোদের মধ্যে তারা পথ চলছে। আমি তোমাদের সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাদের মাফ করে দিলাম। (বায়হাকী ও ইবন খুযায়মা)।

এই দৃশ্যপটটি প্রেমাসক্তির হওয়াটা স্পষ্ট। আর গর্ব করে আল্লাহতায়ালা আলোচনা করেন বলে যে উল্লেখ, তা প্রমাণ করে যে, বান্দার প্রেমাসক্তির ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে বড় প্রিয়। বস্তুত উল্লিখিত কয়েকটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, হজের মধ্যে আশেকানা শান বিদ্যমান। আর একথা বোঝানোর জন্যই এখানে নমুনা স্বরূপ হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। নচেৎ হজের সকল কাজ সম্পূর্ণ আল্লাহর মহব্বতের পরিচয়বাহী। অর্থাৎ মুযদালিফা ও আরাফাতের পাহাড় বেষ্টিত উপত্যকায় অবস্থান, লাব্বাইক বলতে গিয়ে সজোরে চিৎকার করা, নাঙ্গা মাথায় ঘোরাঘুরি করা, নিজের জীবনকে মৃত্যুর মৃত্যুর আদলে সাজানো; অর্থাৎ মৃতলোকদের পোশাক পরিধান করা, নখ, চুল না উপড়ানো, উঁকুন পর্যন্ত না মারা, মাথার চুল না আঁচড়ানো- যার দরুন দেখতে পাগলের মতো দেখায়, মাথা না কামানো, কোনো প্রাণী শিকার না করা, নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে গাছপালা না কাঁটা, ঘাস পর্যন্ত না তোলা- যার মাধ্যমে প্রেমাষ্পদের অলিগলির প্রতি আদব দেখানো হয়; এসব কাজ কী বুদ্ধিমানদের, নাকি পাগলদের? এগুলোর মধ্যে কিছু বিশেষ কাজ যে মহিলাদের জন্য বিধিবদ্ধ নয়, তার একটি বিশেষ কারণ আছে। তা হলো পর্দা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা।

কাবা ঘরের চারপাশে চক্কর দেয়া, সাফা মারওয়ার মাঝখানে দৌড়ানো, নির্দিষ্ট নিশানাগুলো লক্ষ্য করে কঙ্কর মারা, কালো পাথরে চুমো দেয়া, জার জার হয়ে কান্নাকাটি করা, ধূলায় ধূসরিত অবস্থায় তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে আরাফাতে গমন করা প্রভৃতি যে মহব্বতপূর্ণ আমল তা উপরের হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আর যেভাবে হজের মধ্যে প্রেম ও মহব্বতের রঙ রয়েছে, অনুরূপ এই হজ আদায় করার যেসব স্থান সেখানেও পরতে পরতে মহব্বতের নিদর্শন জড়িয়ে আছে। এর ফলে হজের মধ্যে ভালোবাসা ও মহব্বতের আমেজ ও আবেগ হয় আরো তীব্রতর। যেমন কোরআন মজীদে বর্ণিত-

হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র গৃহের কাছে বসবাস করালাম। হে আমাদের প্রতিপালক! এজন্য, তারা যেন নামাজ কায়েম করে। অতএব, তুমি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও। (ইব্রাহীম : ৩৭)। এই দোয়ার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া চোখ মেললেই দেখা যায়। সুদ্দী যা ইবনে আবি হাতেম সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

কোনো মু’মিন এমন নেই, যার দিল কাবা ঘরের মহব্বতে বন্দি নয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হযরত ইব্র্রাহীম (আ.) যদি বলে দিতেন, ‘লোকদের অন্তরকে এদিকে ঝুঁকিয়ে দাও’ তাহলে ঈহুদী নাসারারাও সেখানে ভিড় জমাত। কিন্তু তিনি ঈমানদারদের খাস করে উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘কিছু লোকের অন্তরকে।’ (দুররে মানসুর)।

আরও হাদিসে আছে :

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) (হিজরতের সময় মক্কাকে সম্বোধন করে) বলেন, তুমি কতই না পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর! আর আমার কত প্রিয় তুমি! যদি আমার স্বদেশবাসী আমাকে তোমার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন না করত, তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতাম না। (তিরমিযী : ৩৯২৬)।

যেহেতু প্রত্যেক মু’মিন হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসে, সেহেতু যে শহরকে অর্থাৎ মক্কা মুকাররামাকে তিনি ভালোবাসতেন মুসলমানরাও সে শহরকে ভালোবাসে। এভাবে মক্কার মহব্বতের মধ্যে দুই পয়গাম্বরের দোয়ার প্রভাব প্রতিফলিত। এতো হলো, হজ ও পবিত্র স্থানের ফযিলত প্রসঙ্গ। এর মধ্যে আল্লাহতায়ালা কতিপয় দুনিয়াবী উপকারও রেখেছেন। যদিও হজে এর নিয়ত না করা উচিত। তবে এগুলো এমনিতেই অর্জিত হয়ে যায়। যেমন সামনের দু’টি আয়াতে সে দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ পবিত্র কাবাগৃহকে মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করেছেন। (মায়েদা : ৯৭)।

কল্যাণ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। কাবা ঘরের ধর্মীয় কল্যাণসমূহের ব্যাপার তো স্পষ্ট। আর দুনিয়াবী কল্যাণসমূহের মধ্যে রয়েছে, হেরেম এলাকা নিরাপদ এলাকা হওয়া, সেখানে প্রতি বছর লোক সমাবেশ হওয়া, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জাতীয় ঐক্য খুব সহজে অর্জন করা সম্ভব। আর কাবাঘর যতদিন প্রতিষ্ঠিত আছে, ততদিন এই দুনিয়া টিকে থাকা। এমনকি যেদিন কাফেররা কাবা ঘর ধ্বংস করবে, তার পরপরই কেয়ামত হয়ে যাবে। যা হাদিস শরীফের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়। (ঊয়ানুল কোরআন সংক্ষেপিত)

আল্লাহতায়ালা (হজের উদ্দেশ্যে লোকদের আসার হেকমত সম্বন্ধে) ইরশাদ করেন, তোমরা যাতে নিজেদের (দ্বীনি ও দুনিয়াবী) কল্যাণ লাভের জন্য সমবেত হও। (সূরা হজ : ২৮)।

উদাহরণস্বরূপ, পরকালীন কল্যাণগুলো হচ্ছে, পবিত্র হজ, সওয়াব ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। আর দুনিয়াবী উপকার ও কল্যাণসমূহের মধ্যে রয়েছে, কোরবানির গোশত খাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি।

(সূত্র : মওলানা আশরফ আলী থানবী (রহ.) কৃত হায়াতুল মুসলেমীন)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত