ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২৩৭)

মনের চিন্তা সে আল্লাহর মেহমান

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
মনের চিন্তা সে আল্লাহর মেহমান

বাড়িতে যেয়াফত। ছেলের খতনার অনুষ্ঠান। দূরের কাছের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুমহল এসেছেন। মেহমান নিয়ে ব্যস্ততায় গৃহকর্তা ও গৃহিণীর একটুও ফুরসত নেই। সন্ধ্যা নাগাদ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামাতে পুরো আয়োজনে ছন্দপতন আসে। কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে তারা দু’জনে কথা বলে নেয়: একজন মান্যবর মেহমান এসেছেন। তার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের কামরায়। আজকের জন্য দুটি বিছানা পাতবে। একটি ঘরের ভেতরে দেয়াল ঘেঁষে। আরেকটি দরজার কাছে। মেহমান থাকবেন ভেতরের বিছানায়। আমরা দু’জন দরজার কাছে। যেন মেহমানের ঘুমে ব্যাঘাত না হয়।

স্ত্রী মুখে হাসির রেখা টেনে বলে, ঠিক আছে, কাজ শেষে আমি যখন আসব মেহমান তখন ঘুমিয়ে থাকবেন। কত কাজ যে বাকি। খাওয়া-দাওয়া সেরে গৃহকর্তা ভেতরের বিছানায় বসে মেহমানের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গ আলাপ করে। জীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের নানা কাহিনি সামনে আনে। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মেহমানের চোখে ঘুম নেমে আসে। তিনি উঠে দরজার কাছের বিছানায় শুয়ে পড়েন। গৃহকর্তা লজ্জার কারণে বলতে পারল না, আপনি এই বিছানায় রাত কাটাবেন। ফলে স্বামী-স্ত্রীর পরিকল্পনা পাল্টে গেল। স্ত্রীকে তথ্যটি জানানোর কথাও ভুলে গেল, অনেকটা অলসতাণ্ডঅবহেলায়। এক সময় তিনিও আশ্রয় নেন ভেতরের বিছানায় ঘুমের নিরালায়। রাত ঘনিয়ে আসলে ভারিবর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্ষণ শুরু হয়। গ্রামীণ জীবনে অসময়ের বৃষ্টিতে সবাই অবাক। কাছের মেহমানরা যার যার মতো বিদায় নিল। কর্মক্লান্ত গৃহিণী আশ্রয় নিল দরজার কাছের বিছানায়, যেখানে মেহমান শুয়ে আছেন গভীর নিদ্রায়।

যন বেয়ামদ বর গুমানে আন কে শু

সূয়ে দর খোফতাস্ত ওয়ান সূ আ’ন আমু

স্ত্রী এসে আঁধার হাতড়ে খুঁজে নিল স্বামীর বিছানা

শুয়ে আছে দরজার কাছে, মেহমান ভেতরে- তার ভাবনা।

স্বামী দরজার কাছের বিছানায় ঘুমিয়ে আছেন ভেবে মহিলা মেহমানের চোখে মুখে কয়েকটি চুমো এঁকে দিল। তারপর সারাদিনের নানা বেদনার কথা শুরু করল চাপা স্বরে গভীর মমতায়। কানে মুখ লাগিয়ে মহিলা বলল, ‘যা আশংকা করেছিলাম, তাই হলো। এই যে মেহমানটা এলো। দেখবেন, সহজে আমাদের বাড়ি ছেড়ে যাবে না। আঠার মতো লেপ্টে থাকবে। জোঁকের মতো চুষে খাবে। ভারি বৃষ্টি হওয়াতে তো বাড়তি অজুহাত পেয়ে গেছে। কপালে দুঃখ লেখা ছিল, তা-ই নেমে এসেছে মেহমান হয়ে।

মহিলার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠল মেহমান বিছানায়: তোমরা আমার পথ ছেড়ে দাও। আমার পায়ের জুতা অনেক শক্ত। বৃষ্টি-বাদলের পরোয়া করি না। তোমাদের মেহমানদারীর ধার ধারি না। আমি চললাম।

যাত্রাপথে অতিথিশালায় মুহূর্তের জন্যও আমি শান্তি চাই না। এই দুনিয়ায় আমি মুসফির। এখানে কোনো হোটেলে, মেহমানখানায়, কারো বাড়িতে স্থায়ী নিবাস গড়ব না। মেহমান তো যত তাড়াতাড়ি তার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে চায়। তাই চলার পথে কোনো আরামে তার স্বস্তি নেই। কোথাও যদি মন লেগে গেলে মনযিলে মকসুদ হারিয়ে যাওয়ার আশংকায়। এমনটি হলে তা হবে এই দুনিয়ার যাত্রাপথে ডাকাত পড়ে আক্রান্ত হওয়ার সমান।

মহিলা লজ্জায় জড়োসড়ো। মুখের একটি বেফাঁশ কথায় বৃষ্টিঝরা আঁধার রাতে মেহমান চলে গেলেন। বার কয়েক পেছন থেকে ডাক দিল, ওহে বড় সম্মানিত মেহমান! আমি মস্করা করেছি, ভুল করেছি, আপনি মনে কষ্ট নেবেন না। আপনার উদারতার দোহাই, ক্ষমা করুন, ফিরে আসুন আমাদের গরিবখানায়। ততক্ষণে স্বামীও জেগে উঠল। উভয়ের শত অণুনয়-বিনয় বিফল হলো। তারা অপলকে চেয়ে দেখে, এ তো সাধারণ মেহমান নয়, স্বর্গীয় পুরুষ। যেদিকে যাচ্ছেন তার চেহারার নূরে আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে পথজুড়ে। তার অস্তিত্বের প্রদীপ যেন আঁধার রাতে বেহেশত থেকে নেমে আসা সূর্য। গোটা জগৎ, অন্তর্লোক আলোকিত তার জ্যোতির আভায়। মেহমানকে হারিয়ে তাদের ঘরে রাতের আঁধারে শোকের মাতম। সিদ্ধান্ত নিল, এই ঘর, এই কামরায় আর বসবাস করব না। এখন থেকে এই ঘর হবে মেহমানখানা, মহান অতিথির স্মারণি।

এরপর থেকে যখনই স্বামী-স্ত্রীর স্মৃতিতে মেহমানের কথা ভেসে উঠে, কে যেন এসে তাদের মনের কানে বলে যায় :

কে মানাম য়ারে খিযির সদ গঞ্জে যূদ

মী ফাশানাদ লে-কে রূযীতান নাবূদ

আমি খিযিরের সাথী এসেছিলাম শত ধনভান্ডার নিয়ে

অকাতরে বিলাতে কিন্তু তা ছিলনা তোমাদের কপালে।

আমার পরিচয়, আমি খিযির (আ.)-এর সাথী, আল্লাহর নবী মূসা (আ.) আকুল ছিলেন যার সঙ্গ পেতে। আল্লাহর রহমতের অফুরন্ত ভান্ডার নিয়ে এসেছিলাম তোমাদের মাঝে বিলাতে। কিন্তু তোমাদের কপালে ছিল না সেই সৌভাগ্যের উপহার। শুনো, আমি একবার নয়, বার বার আসি, প্রতিদিন আসি। চিন্তা করলে প্রতিক্ষণে সাক্ষাৎ পাবে আমার সনে তোমাদের মনের বড়িতে।

হার দমী ফিকরি চো মেহমানে আযীয

আয়দ আন্দর সীনেআত হার রূয নীয

প্রতি মুহূর্তে একেক চিন্তা সম্মানিত মেহমান হয়ে

ভেসে উঠে তোমার হৃদয়পটে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে।

প্রতিদিন প্রতিক্ষণে তোমার হৃদয়পটে একটি না একটি চিন্তার উদয় হয়। এই চিন্তাই তোমার জন্য মহা সৌভাগ্যের বাহন মেহমান। আবু তালেব মক্কী যেমনটি কুতুল কুলূব গ্রন্থে বলেছেন, ‘মনের চিন্তা ও কল্পনা আল্লাহর দূত, তুমি তার ডাকে সাড়া দাও।’

মওলানা রুমি বিষয়টি আরও খুলে বলেন, ওহে প্রাণপ্রিয়! তোমার চিন্তাকে মনে করো কোনো সম্মানিত মেহমান, মানুষ। কারণ, প্রত্যেক মানুষের সম্মান নির্ণিত হয় নিজের চিন্তাধারা ও প্রাণের নিক্তিতে।

ফিকর রা আই জান বে জায়ে শাখস দান

যাঁকে শাখস আয ফিকর দারদ কদরো জান

চিন্তাকে হে প্রাণপ্রিয়! মনে কর মানুষের প্রতিরূপ

চিন্তা ও প্রাণের নিরেখে নির্ণয় হয় সবার স্বরূপ।

প্রাণ থাকলে মানুষ জীবিত। প্রাণ চলে গেলে মৃত। প্রাণ থাকলেও যদি মাথায় চিন্তা না থাকে বলা হয় উন্মাদ, পাগল, মানসিক প্রতিবন্দি। কাজেই মানুষের চিন্তাই তার স্বরূপের পরিচায়ক। আবার যার চিন্তা যেমন মানুষটিও তেমন। যার চিন্তাধারা যত উন্নত সে মানুষ তত উন্নত। কাজেই তোমার মনে যে ক্ষণে ক্ষণে চিন্তার উদয় হয়, আবার চলে যায়, মেহমানের মতো তার সমাদর করো।

বলতে পার চিন্তা তো কখনো দুঃখ দুশ্চিন্তার হয়, তাতে কীভাবে বুঝব কোন চিন্তা আমার জন্য ভালো বা মন্দ। মওলানা বলেন, দুশ্চিন্তা কখনো তোমার আনন্দের পথে ডাকাত সাজে, সেই দুশ্চিন্তাই তোমার জন্য আনন্দের সওগাঁত বয়ে আনবে। দুঃখভরা চিন্তা আসলে তোমার দিলের বাড়িতে ঝাড়ু দেয়, ময়লা-আবর্জনা দূর করে। তারপর চিন্তার আসল উৎস থেকে তোমার জন্য আনন্দের সওগাঁত বয়ে আনে। মনের আকাশে দুঃখ-দুশ্চিন্তা শীতের প্রকোপের মতো, গাছগাছালির শুকনো পত্রপল্লব ঝরিয়ে ফেলে। এরপরই নবপত্রের উদ্গম হয়, নতুন কিশলয়ে বসন্তের সমারোহ জাগে।

এই তত্ত্বটি বিশেষত তারাই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন, যারা এ কথায় বিশ্বাস করে যে, দুঃখ দুশ্চিন্তাই মনে একীন ও প্রতীতি আনে। উদাহরণস্বরূপ, যখন দেখ যে, আকাশে মেঘের গর্জন চারিদিক আঁধিয়ারায় ছেয়ে যাচ্ছে- তখন বুঝবে যে, সবুজের সমারোহে প্রকৃতি এবার মন খুলে হাসবে। মনে রেখ, সুলক্ষণ বা অলুক্ষণের চিন্তা তোমার দিলের মেহমান। আকাশের তারকার মতো এরা এই কক্ষ থেকে ওই কক্ষে সন্তরণ করে। যখন দেখ যে, চিন্তার কোনো সিতারা তোমার মনের আকাশে উদিত হয়েছে, তা দুশ্চিন্তার হলেও, তাকে নিয়ে মনখারাপ করো না, দুশ্চিন্তায় বেসামাল হয়ো না। খোলা মনে তাকে স্বাগত জানাও। যাতে চিন্তার সেই সেতারা চাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সেতারা চাঁদের সঙ্গে কথা বলবে। আল্লাহর কাছে গিয়ে বলবে, কিছুদিন আমি তোমার বান্দার ঘরে মেহমান ছিলাম; কিন্তু আমার কারণে কোনো দিন সে মন বেজার করেনি। মুখে কোনো অভিযোগ করেনি। তোমার প্রতি নারাজি দেখায়নি। বরং ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। তার অবস্থার ভাষা ছিল, ‘ইলাহী নাহমাদুকা আলা বালায়িকা কমা নাশকুরুকা আলা না’মায়িকা’ ‘প্রভু হে! আমি তোমার দেয়া বালা-মুসিবতের মধ্যেও তোমার প্রশংসা করি, যেভাবে তোমার নেয়ামতরাজি পেয়ে তোমার শোকারিয়া আদায় করি।‘

হাফত সাল আইয়ুব বা সবর ও রেযা

দর বলা খোশ বূদ বা যাইফে খোদা

সাতটি বছর আইউব ধৈর্য ও সন্তুষ্টির সঙ্গে

মুসিবতে খুশি ছিলেন আল্লাহর অতিথি নিয়ে।

যাতে সেই বালা-মুসিবত ফিরে গিয়ে বলে, আল্লাহ! আমি তোমার মেহমান হয়ে তোমার বান্দা হযরত আইয়ুব (আ.)-এর কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে বরণ করে ধৈর্যের পরাকাষ্টা দেখিয়েছেন। তোমার ভালোবাসায় সবকিছু হাসিমুখে বরণ করেছেন। এক মুহূর্তের জন্যও গোমড়া মুখ হননি। আমি বালা-মুসিবত যেন তার কাছে দুধ ও মধুর মতো সুপেয় ছিলাম। তার মনের সার্বক্ষণিক ভাষা ছিল-

রব্বি আউযিইনী লি শুকরি মা আরা

লা তুআক্কিব হাসরাতান লী ইন মযা

প্রভু হে! যাকিছু দেখি তার শোকর করার তাওফিক দাও

যে নেয়ামত হারিয়ে গেছে তার দুশ্চিন্তায় ফেলো না কখনও।

তোমার যে নেয়ামত এ মুহূর্তে ভোগ করছি তার শোকর আদায় করার শক্তি দাও। আর যা হাতছাড়া হয়েছে, তার জন্য হাহুতাশ যেন না করি, সেই তওফিক দাও।

(মওলানা রুমির মসনবি শরীফ, ৫খ. বয়েত: ৩৬৪৭-৩৭০৭)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরীফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবীর গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত