ঢাকা সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভালোবাসার আমেজে হজ ও ওমরা

ভালোবাসার আমেজে হজ ও ওমরা

হযরত ইবনে আবি হাতেম (রহ.) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন, (রূহুল বয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী) হজের বৈশিষ্ট্যের মতো আরো একটি ইবাদত আছে। তা হচ্ছে ওমরা- যা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তারও স্বরূপ হচ্ছে, হজের কতিপয় আশেকানা কার্যাবলি। এ জন্য এর উপাধি হচ্ছে ছোট হজ। যেমন-

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ও হযরত মুজাহিদ (র) হতে ওমরা সম্পর্কিত এ আলোচনা বর্ণিত হয়েছে। (দুররে মনসূরে আবি শায়বা হতে) তবে এটি হজের মওসুমেও হয়। যার ফলে একই শান ও মানের দু’টি ইবাদত একত্র হয়। অন্য সময়েও পালিত হয়।

আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, যখন হজ বা ওমরা একসাথে পালন করবে তখন হজ ও ওমরা আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে আদায় করো। (সূরা বাকারা, আয়াত, ১৯৬)। যাবতীয় শর্ত ও কার্য যথাযথভাবে পালন করো আর নিয়তও করো খালেস সওয়াবের।

হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যার সামনে কোনো বাহ্যিক অন্তরায়, কিংবা জালিম বাদশাহ কিংবা অক্ষম করে দেয় এমন অসুস্থতা হজ থেকে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, এরপরও সে হজ না করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সে ইহুদি হিসেবে মরুক কিংবা খ্রিষ্টান হিসেবে মরুক। (দারেমী সূত্রে মিশকাত)। ফরজ হজ আদায় না করার কারণে কী কঠোর ভাষায় ধমক প্রদান করা হয়েছে, তা কী চিন্তা করা যায়?

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজের ইচ্ছা করে তার উচিত তাড়াতাড়ি হজ করে ফেলা। (আবূ দাউদ,) হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (যদি হজের মওসুমে হয়) হজ ও ওমরা একত্রে আদায় করে নিও। উভয়ই দারিদ্র্য এবং গোনাহগুলো দূরে সরিয়ে দেয়। যেমন হাঁপর-লোহা ও সোনা চাঁদির জং পরিষ্কার করে দেয় (যদি এর বিপরীত প্রভাব সৃষ্টিকারী কোনো কিছু পাওয়া না যায়।) আর যে হজ সতর্কতার সঙ্গে করা হয় তার বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। (তিরমিযী : ৮১০)।

হজ ও ওমরার দ্বীনি উপকার এবং একটি দুনিয়াবী উপকার উল্লেখ করা হয়েছে। আর গোনাহ বলতে বোঝায় আল্লাহ্র হক নষ্ট হওয়া। কেননা, হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক তো আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হলেও মাফ হয় না। (মুসলিম সূত্রে মিশকাতে বর্ণিত ঋণ সম্পর্কিত হাদীস)।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, পয়গাম্বর (আ.) ইরশাদ করেন, যারা হজ করেন এবং ওমরা পালন করেন, তারা আল্লাহর মেহমান। তারা যদি দোয়া করেন তো আল্লাহ পাক তাদের দোয়া কবুল করেন। তারা যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান তো আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন। (ইবন মাজা সূত্রে মিশকাত)।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ করা বা ওমরা করা কিংবা জিহাদ করার উদ্দেশ্যে রওনা হলো আর সে রাস্তায় (সেসব কাজ আঞ্জাম দেওয়ার পূর্বে) মারা গেল, আল্লাহতায়ালা তার জন্য গাজী ও ওমরা পালনকারীর সওয়াব লিখে দেবেন। (বায়হাকী সূত্রে মিশকাতু)।

হজের সঙ্গে সম্পর্কিত তৃতীয় একটি আমল আছে। তা হচ্ছে, হুজুর আকদাস (সা.)-এর রওজা শরীফের জিয়ারত। যা অধিকাংশ আলেমের দৃষ্টিতে মুস্তাহাব। হজের মধ্যে যেমন আল্লাহর মহব্বতের শান ও আমেজ আছে, তেমনি জিয়ারতের মধ্যে আল্লাহ্র রাসূলের প্রেম ও মহব্বতের আমেজ ও শান বিদ্যমান। হজের মাধ্যমে আল্লাহর মহব্বতে যেমন উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধিত হয়, তেমনি যিয়ারতের দ্বারা আল্লাহর রাসূলের মহব্বত বৃদ্ধি পায়। আর যার অন্তরের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত থাকবে তার দ্বীনের উপর কতই না মজবুতি হবে? প্রেমের এই আকর্ষণের পরিচয় মেলে পরবর্তী হাদিস থেকে।

হযরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ পালন করে, আর আমার ওফাতের পর আমার কবর যিয়ারত করে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। (বায়হাকী সূত্রে মিশকাতূ)।

হুযুর আকরাম (সা.) উভয় সাক্ষাৎ অর্থাৎ জীবদ্দশায় সাক্ষাৎ এবং ওফাতের পর যিয়ারতকে সমান বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে যেহেতু কোনো বিশেষ ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ নেই, সেহেতু প্রত্যেক প্রভাবের ক্ষেত্রে তা সমান হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, জীবদ্দশায় যদি তার সঙ্গে কারো সাক্ষাৎ হতো তাহলে কী পরিমাণ ভালোবাসা ও মহব্বত অন্তরে সৃষ্টি হতো। কাজেই নবীজির ওফাত লাভের পর যদি কেউ কবর জিয়ারত করে তাতেও সেই ধরনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া অন্তরে সৃষ্টি হবে। এখানে হাদিসটি উপরোক্ত দাবির পক্ষে দলিল হিসেবে উল্লেখ করা হলো। নচেত যিয়ারতের দ্বারা অন্তরে আল্লাহর রাসূলের মহব্বত বৃদ্ধি পাওয়ার যে প্রভাব পড়ে তা তো প্রকাশ্যেই দেখা যায়।

যেভাবে হজের জায়গা অর্থাৎ মক্কা মুয়াজ্জমায় মহব্বতের মহিমান্বিত শান রাখা হয়েছে, তেমনি এই যিয়ারতের স্থান মদীনা মোনাওয়ারায়ও ভালোবাসার মহিমান্বিত শান নিহিত রাখা হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে (এক দীর্ঘ হাদিসে) বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আল্লাহ! তিনি (অর্থাৎ ইবরাহীম আ.) তোমার কাছে মক্কার জমিনের জন্য দোয়া করেছেন, আর আমি তোমার কাছে মদীনার জমিনের জন্য দোয়া করছি। তাও এবং তার মতো আরও...। (মুসলিম : ৩৩৩৪)।

হযরত ইবরাহীম (আ.) মক্কা মুয়াজ্জমার জন্য মাহবুবিয়্যত (বা প্রিয়ভাজন হওয়া)-এর দোয়া করেছেন। কাজেই মদীনা মুনাওয়ারার জন্য দ্বিগুণ মাহবুবিয়্যত (প্রিয়তার) দোয়া হিসেবে গণ্য হবে।

হযরত আয়েশা (রা.) হতে (এক দীর্ঘ হাদিসে) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আল্লাহ! মদীনাকে আমাদের কাছে প্রিয়ভাজন করে দাও, যেভাবে আমরা মক্কাকে মহব্বত করতাম সেভাবে। বরং এর চেয়েও বেশি...। (বোখারি : ১৮৮৯)

হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন, (মদীনার কাছাকাছি এসে) মদীনার দেয়ালগুলো নজরে আসতেই সওয়ারীর গতি বাড়িয়ে দিতেন। আর এমনটি করতেন মদীনার প্রতি ভালোবাসার কারণে। (বোখারি : ১৮৮৬)

প্রিয়তমের কাছে যাকিছু প্রিয়তম তা যেহেতু প্রিয়তম হয়ে থাকে, সেহেতু মদীনার সঙ্গেও সব মুসলমানের মহব্বত থাকতে হবে হবে। হযরত ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা নেই, যা আমার কবর হওয়ার জন্য মদীনার চেয়ে প্রিয়তর। তিনি এ কথাটি তিনবার বলেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)। এসব রেওয়াত এ কথা প্রমাণ করে যে, হজ, ওমরা ও যিয়ারতের দ্বারা মহব্বত বৃদ্ধি পায়। অবশ্য হজ ও যিয়ারত এবং সেই পবিত্র স্থানগুলোর মহব্বত ঈমানদারদের অন্তরে বিদ্যমান থাকার পক্ষে কোনো যুক্তি প্রমাণের প্রয়োজন নেই। এই মহব্বতের প্রভাব অবশ্যই আমাদের দ্বীনি জীবনের ওপর পড়ে, আমদের দ্বীনি জীবনকে সুুন্দর ও মহব্বতের চেতনায় পুলকিত করে। কাজেই হে সামর্থ্যবান মুসলমানরা! এই মহাসম্পদকে হাতছাড়া করবেন না। (সূত্র : মওলানা আশরফ আলী থানবী (র.) কৃত হায়াতুল মুসলেমীন)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত