ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নৈতিক অবক্ষয় রোধে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব

শাফিউর রহমান
নৈতিক অবক্ষয় রোধে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব

সরকারি-রেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিন বলে থাকেন, বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌছেছে; কিন্তু কেন এই নৈতিক অবক্ষয়- সে ব্যাপারে সঠিক নির্দেশনা তারা দেন না, দিতে পারেন না। নৈতিক অবক্ষয়ের আসল কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার অভাব। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ ইসলাম শিক্ষার সুযোগ নেই।

ইসলাম নৈতিক চরিত্রের ভিত্তি হিসেবে যা নির্দেশ করেছে তার মূল কথা হল, যাকিছু ভালো তা গ্রহণ কর আর যাকিছু মন্দ তা বর্জন কর। এক কথায় বলতে গেলে নৈতিকতার মূল চাবিকাঠি হলো তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় মিশ্রিত জীবনযাপন। ইসলাম মানুষকে যে সকল বিষয়ে চিন্তা বা কাজ করতে নিষেধ করে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ভয়ে সে সব চিন্তা-ভাবনা, কথাবার্তা ও কার্যকলাপ হতে বিরত থেকে ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করার নাম তাকওয়া। শুধু তখনই নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধিত হবে। এটিই ইসলামী শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য।

একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হলে তাকে ছোটবেলা থেকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রথমে এ দায়িত্ব থাকবে তার পিতা-মাতা এবং পরিবারের উপর। দ্বিতীয় স্তরে দায়িত্ব থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। ছোট থেকে একটি শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য যে যে শিক্ষার প্রয়োজন, তা যদি পরিবার থেকে দেয়া হয়, তাহলে সে নিজেকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারবে।

অপরদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি প্রাইমারি শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা থাকে তাহলে একজন মানুষ আদর্শ নাগরিক ও সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। দুঃখ ও পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই; অথচ আমাদের সমাজব্যবস্থা নৈতিকতার দিক দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। এমনকি যারা বড় বড় শিক্ষিত তাদের অনেকের মধ্যে নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ সবচে জঘন্য। হানাহানি, অশ্লীলতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অনাচার, জেনা-ব্যভিচার, খুন-খারাবি শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার মধ্যে বিদ্যমান।

এর মূল কারণ আমাদের মধ্যে প্রকৃত ধর্মীয় বা ইসলামী শিক্ষার অভাব। আমরা অনেকে নামাজ দোয়ায় যত্ন নেই; কিন্তু ব্যক্তি জীবনে সৎ হতে হবে, সমাজ জীবনে মানুষের সেবা করতে হবে, এমন চেতনায় আমরা অনেকে চালিত নই। কথায় বলে, নামে মুসলমান। একজন মুসলিমের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে আদর্শ-চরিত্র গঠনের আদেশ দিয়েছেন আমরা তা পালন করছি না। তাই যদি হতো তাহলে আজ আমাদের দেশ এবং মুসলিম বিশ্বের ওপর এই দুর্দশা নেমে আসত না। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ও নৈতিক চেতনায় জাগ্রত হলে, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ইহুদিরা আজ ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারত না। কাজেই আমাদের এখন উচিত প্রকৃত মুসলিমের চরিত্র অর্জন করা। আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধর্মীয় তথা ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা। এখানে একটি কথা না বলে পারছি না। ধর্মীয় শিক্ষা বলতে আমরা বুঝে থাকি শুধুমাত্র নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতির জ্ঞান বা কোরআন হাদিস ও আরবি ভাষায় প্রচলিত জ্ঞানচর্চা। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ তো এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন একাধারে ন্যায়পরায়ণ শাসক, বিচারক, সুদক্ষ সেনানায়ক, দুরদর্শী রাজনীতিবিদ, মহান সংস্কারক এবং সফলকাম একজন ধর্মীয় নেতা।

স্বামী হিসেবে তিনি আমাদের আদর্শ, পিতা হিসেবে জগতের মুসলমানদের জন্য আদর্শ, সেনানায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন আদর্শ, রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি আদর্শ। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সকল মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ স্থাপন করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে মানব চরিত্রে যতগুলো মহৎ গুণ থাকতে পারে, মানুষ সুন্দর ও মহৎ যা কিছু কল্পনা করতে পারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রে তার সবগুলোরই অপূর্ব সমাবেশ ও পরিপূর্ণতা দেখতে পাওয়া যায়। তাই আমাদের উচিত হবে নৈতিক শিক্ষার একমাত্র ভিত্তি হিসেবে নবী জীবনের আদর্শ তথা ধর্মীয় বা ইসলামী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। এছাড়া ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সব চ্যলেঞ্জ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিতে পারে- এমন আদর্শ ও সাহসী মুসলমান গড়ে তুলতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে।

ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের পর বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এটা খুবই আনন্দের কথা।

তবে এই উদ্যোগ নিতে হবে প্রধানত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ নৈতিক শিক্ষা হতে হবে ধর্মীয় চেতনাভিত্তিক। মুসলমান সন্তানদের কোরআন ও হাদিসের আলোকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার শিক্ষা দিতে হবে। অন্য ধর্মের অনুসারীদেরও তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

মোটকথা প্রকৃত মুসলিম হিসেবে প্রত্যেক শিশুর আদর্শ চরিত্র গঠনের সহায়ক হিসাবে সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। তাহলে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে ভবিষ্যতে সুনাগরিক হতে পারবে। এর পথেই দেশকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে এবং নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় সফল হবে।

লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও মিডিয়াকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত