মাসুমা তালুকদার তিন্নি। ‘কুমন বনশ্রী এডুকেশন সেন্টার’র প্রশিক্ষক ও সেন্ট্রাল ইনচার্জ। একসময় স্বপ্ন দেখতেন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবেন। পড়লেন ইঞ্জিনিয়ারিং, করলেন শিক্ষকতা অথচ হলেন উদ্যোক্তা। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়লেও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পারিবারিক প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ তিনি সফল নারী উদ্যোক্তা। মাসুমা তিন্নির সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন রেজাই রাব্বী
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিন্নি। যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন তখন থেকেই শিক্ষকতা শুরু করেন, তার প্রথম পেশাজীবন শুরু হয় ২০১২ সালে মাইলস্টোন ইংলিশ ভার্শন স্কুল থেকে। তিন্নি জানান, জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্ত কাটিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর ২০১৭ সালে কয়েকটি কোম্পানিতে সিভি ড্রপ করেন। কয়েক দিন পরই কিছু কোম্পানি থেকে সাড়া পান। এর মধ্যে ‘ব্র্যাক কুমন লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও ছিল। কুমন সম্পর্কে তিন্নি বলেন, শুরুতে তেমন ধারণা না থাকলেও ব্র্র্যাকের প্রতিষ্ঠান দেখেই এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর ব্রাক কুমনের ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে যখন কাজ শুরু করেন, তখন অনেক মন্দ কথার সম্মুখীন হতে হয়।
কিন্তু এগুলোতে কিছু মনে করতেন না। তিনি জানান, ২০১৭ সালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হয় কুমনের যাত্রা। জাপানিজ গণিত শিক্ষক তরু কুমনের আবিষ্কার করা প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি পুরোনো কুমন মেথড বর্তমানে বিশ্বের ৫৭টিরও বেশি দেশে শিশু-কিশোরদের গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে এবং জীবনমুখী দক্ষতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। কুমন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে ২৪ হাজারের বেশি শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করে। কুমন শিক্ষার্থীদের একাডেমিক দক্ষতা উন্নত করার ও শেখার প্রতি ভালোবাসা বাড়ানোর প্রমাণিত ট্র্যাক রেকর্ডসহ প্রায় ৩৬ লাখ শিক্ষার্থীকে সেবা দিচ্ছে। কুমন একটা জাপানিজ অর্গানাইজেশন। তিন্নি বলেন, ব্র্যাকের প্রশিক্ষণে জাপানিজ টিম আমাদের প্রশিক্ষণ করাত। প্রশিক্ষণ শেষে উপলব্ধি করলাম আমরাতো পড়াশোনাটাকে একটু ভয়-ভীতি হিসেবে মনে করি, কিন্তু পড়াশোনা খুবই সহজ ও বিস্ময়কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে এটা এই কুমন প্রশিক্ষণে বুঝতে পারলাম। প্রশিক্ষণ শেষে দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর কুমন উত্তরা সেন্টারে কাজ করেছি।
ব্র্যাকে কর্মরত অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট হওয়ার পর ভাবতাম কী করব, কোন পেশায় যাব, শিক্ষকতাই থাকব নাকি অন্য কোন পেশায় যোগদান করব! এভাবে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আরো কিছুদিন শিক্ষকতা করলাম। এর কিছুদিন পর ব্র্যাক কুমন লিমিটেড থেকে নারী উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজ অফার দেয়া শুরু করল।
তখন আমার মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করল! আমি তো একজন নারী, আমি কি পারব একজন উদ্যোক্তা হতে, আমি কি পারব কোনো উদ্যোগ নিলে সফলভাবে পরিচালনা করতে! কিন্তু আমার মধ্যে একটি মনোভাব কাজ করল যে আমি তো একজন ব্র্যাকের কর্মী, আমি হয়তো পারব একজন নারী উদ্যোক্তা হতে বা একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হলে সেখানে অনেক দায়িত্ব থাকে। কারণ, একজন চাকরিজীবী তার মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ইনকাম থাকে কিন্তু একজন উদ্যোক্তার এরকম নির্দিষ্ট পরিমাণ ইনকাম কোনো থাকে না।
কিন্তু তার চিন্তা থেকে যায় মাস শেষে সে তার প্রতিষ্ঠান কীভাবে চালাবে, কীভাবে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন দেবে। তারপরও সিদ্ধান্ত নিলাম আমি একজন উদ্যোক্তা হব। অন্য মেয়েরা যদি উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে পারেন তাহলে আমিও পারব। নিজের আত্মবিশ্বাস থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। কিন্তু উদ্যোগ গ্রহণের শুরুর দিকে পারিবারিক আবহ আমার অনুকূলে ছিল না। উদ্যোক্তা হওয়ার কথা পরিবারে জানালে আমার বাবার পরিবার আমাকে নিয়ে উপহাস করে। তারা বলেন মেয়ে বড় হয়ে বিয়ে করবে, মেয়ের আবার উদ্যোক্তা হবে কিসের! মেয়ে বড় হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দাও। কিন্তু ওই সময় মা আমাকে মানসিক, আর্থিক এবং সর্বোপরি সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার জন্য মা এবং বোনকেও উপহাসের শিকার হতে হয়েছে, নানা ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে বন্ধু-বান্ধব ও অফিসের কলিগদের সাথে পরামর্শ করলে তারা খুব সাপোর্ট করে। অন্যদিকে, কুমন বনশ্রী এডুকেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান বনশ্রী সেন্টারের অপারেশন ম্যানেজার শাকিল স্যার ও ব্র্যাক কুমন লিমিটেডের সুপারভাইজার নেহাল ভাই এবং ওবায়েদ ভাই যথেষ্টভাবে সাপোর্ট করেছেন। তবে এর মধ্যেও নানা রকমের বাধা-বিপত্তি ছিল। মানুষ নানাভাবে নানা রকম কথা বলেছে।
অনেকে বলেছে একটা হ্যান্ডসাম বেতনের চাকরি ছেড়ে কেন ঝুঁকির মধ্যে যাবা? কেন তুমি উদ্যোক্তা হবা? তুমি তো চাইলে আরো ভালো পজিশনে আরো ভালো ইনকাম করতে পারো চাকরির মাধ্যমে। কিন্তু চেয়েছিলাম আমি একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে সফলতা অর্জন করব। আমি একটা কথাই ভাবতাম, কথায় আছে ভয়ের পরেই জয়। শত বাধা-বিপত্তির পরও ২০২২ সালে ব্র্যাক কুমন লিমিটেডের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিংয়ের জন্য আবেদন করি। এরপর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ‘কুমন বনশ্রী এডুকেশন সেন্টার’ নিবন্ধিত হয়। জাপানিজ শিক্ষাপদ্ধতি কুমন বনশ্রী এডুকেশন সেন্টারের প্রশিক্ষক এবং কেন্দ্রের ইনচার্জ মাসুমা তালুকদার তিন্নি ফ্র্যাঞ্চাইজ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘কুমন’র বনশ্রী সেন্টার আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। কুমন বনশ্রী এডুকেশন সেন্টারের মাধ্যমে বেশ কিছুসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে কুমন বনশ্রী এডুকেশন সেন্টারে প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এখানে শুধু একাডেমিক পড়াশোনাই না শিশুদের মানসিক বিকাশ, কনফিডেন্স লেভেল, কথার জড়তা, শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা এবং শিশুকে স্মার্টভাবে গড়ে তোলা হয়। শিশুর দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজন পরে যে স্কিলগুলো, তা নিয়েও শিক্ষা প্রদান করা হয়।