দীর্ঘক্ষণ প্রসবযন্ত্রণায় থাকার পর মা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাই তার প্রয়োজন তরল পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রশান্ত ঘুম। মা হওয়ার পর কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল অথবা গা মুছে আরামদায়ক পোশাক পরা দরকার। জীবাণুমুক্ত স্যানিটারি প্যাড পরা উচিত। শিশু জন্মের পর প্রথম ২ ঘণ্টা, ১৫ মিনিট পরপর মায়ের তলপেটে হাত দিয়ে জরায়ু ম্যাসাজ করে দিতে হবে। রক্তক্ষরণ কেমন হচ্ছে, সেটা মা নিজে যেমন খেয়াল রাখবেন, তেমনি পরিবারের সাহায্যকারী অথবা স্বাস্থ্যকর্মীরাও লক্ষ্য রাখবেন। রক্তক্ষরণ বেশি হলে অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হবে। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার কিছু ওষুধ আছে। সেই সঙ্গে আধা ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে মায়ের দুধ দিতে হবে। এতেও কিন্তু রক্তক্ষরণ কিছুটা কমে আসবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, যাতে কোনো সংক্রমণ না হয়। মা বিছানা থেকে উঠে হাঁটতে চাইলে একজন সাহায্যকারী যেন সব সময় তার পাশে থাকেন। মায়ের নাড়ির গতি, রক্তচাপ ও রক্তস্রাবের পরিমাণ ঠিক আছে কি না, সেটা দেখারও প্রয়োজন আছে।
মায়ের খাবার : মায়ের খাবার যেন সুষম হয়। ভাত, মাছ, শাকসবজি, ডাল, ফল, মাংস, ডিম, দুধ সব ধরনের খাবারই মাকে দিতে হবে। স্বাভাবিক যে খাবার খেতেন, স্তন্যদায়ী মা হওয়ার পর এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে একমুঠো ভাত দুই বেলা, এক বাটি ঘন ডাল দুবার, এক বাটি শাকসবজি দুবার খেতে হবে। ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণের জন্য ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফল, পাকা কলা, ডিম ও দুধ খাবেন। অর্থাৎ বাড়তি খাবার থেকে আরও ৫০০ কিলোক্যালরি পেতে হবে। প্রচুর পানি খাবেন। তাহলে শিশুটি ভালো দুধ পাবে এবং মায়ের শরীরের ক্ষয়পূরণে সাহায্য করবে। পরিবারের সবাই নতুন মাকে সাহায্য করবে। মা নিজেও নিজের শরীরের যত্ন নেবেন।
মানসিক স্বাস্থ্য : এ সময় মেয়েরা একটু আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন। হরমোন ও স্ট্রেসের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রথমবার মা হওয়ার পর মেয়েরা একটু দিশাহারা বোধ করেন। খাওয়া ও ঘুম সময়মতো হয় না বলে মেজাজ হয়ে পড়ে খিটখিটে। পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা এ সময় গুরুত্বপূর্ণ। কোনোভাবেই মায়ের মনে আঘাত দিয়ে কোনো কিছু করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে স্বামীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যদি মনে হয় মা পোস্টপারটাম বিষণ্ণতা বা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। মাকে সবাই মিলে সাহায্য করলে ও সমর্থন দিলে এ জটিল-কঠিন সময় স্বাচ্ছন্দ্যে পার করা সম্ভব।
ব্যায়াম : প্রসব-পরবর্তী সময়ে শারীরিক অবস্থা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যায়ামের প্রয়োজন আছে। প্রসবের সময় প্রচুর রক্তপাত হয়ে থাকে। রক্তস্বল্পতা কাটাতে আয়রন ফলিক বড়ি আর মাতৃদুগ্ধদানের জন্য ক্যালসিয়াম বড়ি সেবন করতে হয় তিন মাস। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা দরকার। প্রসব-পরবর্তী ছয় মাস ভারি ব্যায়াম বা ভারি কাজ না করাই ভালো। তবে নিয়মিত হাঁটা-হাঁটি ও শেখানো কিছু নিরাপদ ব্যায়াম করা যেতে পারে ফিটনেস ফিরে পেতে।
দুগ্ধদান : শালদুধ ফেলা যাবে না। তাই আধা ঘণ্টার মধ্যেই বুকের দুধ দেয়া দরকার। তারপর যখনই শিশু কাঁদবে বা খেতে চাইবে, মা দুধ দেবেন। বুকের দুধ সঠিকভাবে পেতে সঠিক অ্যাটাচমেন্ট, পজিশন ইত্যাদি শিখে নিতে হবে। পর্যাপ্ত বুকের দুধ খাওয়াতে পারলে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যও উজ্জীবিত থাকবে। স্তন্যদানকারী মায়ের জন্য সামনেটা খোলা, এমন ঢিলেঢালা হালকা পোশাক বেশি আরামদায়ক। ব্রেস্টফিডিং ঠিকভাবে না করলে বুকে দুধ জমে ইনফেকশন বা অ্যাবসেস হতে পারে, টনটনে ব্যথা করতে পারে। তাই ঠিকমতো ব্রেস্টফিডিং করানো জরুরি। দুধ তৈরি ও নিঃসরণের জন্য অনেক হরমোন নিঃসরিত হয়। এসব হরমোন মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। মাকে রক্তস্বল্পতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের চর্বি কমানো, হার্টের অসুখ, স্তন ক্যান্সার ও ওভারির ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করে। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যাপারেও মাতৃদুগ্ধদান সাহায্য করে।
লেখক : স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ।